আমার সোনা বউ | Daily Chandni Bazar আমার সোনা বউ | Daily Chandni Bazar
logo
প্রকাশিত : ২ আগস্ট, ২০২৪ ১৪:১১
চাঁদনী সাহিত্য -
আমার সোনা বউ
সাহিত্য কলামঃ

আমার সোনা বউ

ছবি: Vecteezy

ইসলাম রফিকঃ স্বপ্নের মতো জীবন শুরু হয় মানুষের। স্বপ্ন দিয়ে শুরু, স¦প্ন দিয়েই চলা আর স্বপ্নকে অবলম¦ন করেই বেঁচে থাকা। আমারও স্বপ্ন ছিল নিরালা আমার বউ হবে, ঘরণী হবে, হবে সুখ দুঃখের সাথী। কিন্ত সব কিছু তো আর নিজের মতো হয়না। আমরা ভাবি এক, আর উনি ভাবেন আরেক। আমাদের শুধু চাওয়ার আছে, দেয়ার মালিক তো তিনি। তার অপার ক্ষমতা।

একাদশ শ্রেণীতে পড়ি। একাদশ মানে আবেগ, একাদশ মানে প্রেম, একাদশ মানে ভালোবাসা, উদ্দাম ভালোবাসা। অভিভাবকরা বলেন—ছেলেমেয়েদের দুই সময় বেশি নজর দিতে হয়। ক্লাশ নাইনে আর একাদশ শ্রেণীতে। এই দুই সময় নাকি ঈশ্বর প্রদত্ত প্রেম ভর করে ছেলেমেয়েদের। পৃথিবীর কোন বাধা তাকে আটকাতে পারেনা। স্বর্গ থেকে আসে প্রেম স¦র্গে চলে যায়। সেই স্বর্গের প্রেমকে ছেলেমেয়েরা মুঠোবন্দি করে ফেরি করে বেচে। যার মাসুল দিতে হয় পিতা—মাতাকে। আমারও একাদশ শ্রেণী। টাকার অভাব ছিল বলেই প্রাইভেট পড়াতে হয়। ছাত্রদের উপার্জনের একমাত্র উপায় প্রাইভেট পড়ানো। আমিও শুরু করলাম, পাশের বাসা দিয়ে। একজন দিয়ে শুরু হয়ে তিনজনে গিয়ে ঠেকে। তিন ভাইবোন। তৃতীয় শ্রেণীতে দুইজন আর একজন ক্লাশ সেভেনে। পড়াশোনায় ভাল ছিলাম বলে খুব তাড়াতাড়িই প্রাইভেট পড়ানোটাকে রপ্ত করতে পেরেছিলাম। সব বিষয় পড়াতে হয়। ফলে অনেক সময় যায়। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগতো, মনে হতো দূর ছাই এগুলো ছেড়ে দিই। কিন্তু পারি কই ? পারিবারিক অসচ্ছলতা অনেক কিছুতেই সায় দেয় না। পড়াতে থাকি, নিজেরও পড়া হয়ে যায় অনেক কিছু। ক্লাস সেভেনের পা—টা মাঝে মাঝেই আলগা হয়ে যায়। আলগা পা আলগা থাকে না, আরেক জনের পায়ে এসে পড়ে। প্রথমে মনে হতো ভুলে বোধ হয়। কিন্ত পা—টি নিয়মিত পড়তে থাকে ভুলে কিংবা নির্ভুলে। ধীরে ধীরে পা—ই হয়ে ওঠে ভাষার প্রধান আশ্রয়। চোখের ভাষার কথা জানতাম, শরীরের ভাষারও কথাও জানতাম, কিন্ত পায়েরও যে ভাষা আছে, সেই প্রথম জানা। পায়ে পায়ে প্রেম ! পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত এটিই প্রথম ঘটনা, পায়ে পায়ে প্রেম। পড়াতে আর বিরক্তি লাগে না, ক্লান্তিও লাগে না, সময়ও বেশী মনে হয় না। কেন এমন হয় ? উদগ্রীব হয়ে বসে থাকি কখন পড়াতে যাবো। পড়ানো মানে, নিজেকে পড়া, নিজেকে জানা, প্রেমকে নবায়ন করা, মনের গোপন কথাকে প্রকাশ্যে রুপ দেয়ার আশ্রয়। আঙুল দিয়ে পড়া দেখাতে গিয়ে আঙুল লাগে। অন্যরম এক অনুভূতি কাজ করে শরীরে। শিহরণ বয়ে যায়, কিসের সে শিহরণ ? জানিনা। বুঝি একাদশ শ্রেণী মানে যৌবন। একাদশ শ্রেণী মানে কী ভালোবাসা ? আমার ভেতর অন্যরকম আকুতি জাগে, অন্যরকম অনুভূতি জাগে। গোপনে বন্ধুর সাথে শেয়ার করি, বন্ধু উসকে দেয় কিংবা বারণ করে কিংবা পরিস্থিতি বুঝি সিদ্ধান্ত দেয়।

গভীরতার দিকে যায় প্রেম। তখন একা একা থাকতে ভাল লাগে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়তে ভালোলাগে। সারা বিকেল শরৎ চন্দ্রের উপন্যাস পড়ে চোখ লাল করে বেরোয়। মনে হয় আমিই দেবদাস, সাবিত্রী চরিত্রের কথা মনে হয়। কত চরিত্র চোখের সামনে এসে ভীড় করে। শরৎচন্দ্রের চরিত্রগুলো এ সমাজের হলেও কেন যেন বেশী সরল, বেশি আন্তরিক কিংবা বেশি হৃদয়বান। আমার নায়িকা যদি সাবিত্রীর মতো, পার্বতীর মতো— এমন হতো !

সময় দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়। প্রেমের সময়ের গতি খুব বেশী আর দুঃখের সময়ের গতি খুব ধীর। ভালো দিনগুলো বেশী দিন থাকে না, কেন যেন নষ্ট হয়ে যায় কিংবা ঈশ্বরের সহ্য হয় না, তাই তাড়াতাড়ি ভেঙে দেয়। পাশের বাড়ী বলে সবসময় দেখা, সব সময়ই কথা বলা। চোখাচুখি, মুখোমুখি প্রতি সময়ের ঘটনা। বিকেল হলে লুডো খেলা। তিনজনে—আমি, সে আর বাসন্তী। আমাদের প্রেমের অনেক বিষয় তার সাথে শেয়ার করতাম। তিনি সাহস যোগাতেন, সহযোগিতা করতেন। প্রতিদিন বিকেলে নিয়ম করে লুডো খেলতাম আমরা। শুধুই কি লুডু খেলতাম ?  আজ মনে হয়—লুডুর ছলে প্রেম নিবেদন করতাম, নিজেকে প্রকাশ করতাম। আহা লুডু খেলা ! পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিকদের সঙ্গী হয়ে থেকো। আমাদের বাসায় কোন টিভি ছিল না, ওদের বাসায় ছিলো। ফলে প্রতি রাতে সবাই মিলে ঘটা করে টিভি দেখা। প্রতি মাসের শেষে ঘটা করে সিনেমা দেখা, আর সিনেমার কাহিনীর মতো আমাদের চোখের বিনিময়। চোখের সে ভাষা আমাদের ছিলনা, ছিলো ঈশ্বরের। এভাবেই কাটে, কাটতেই থাকে এবং আরো কাটতেই পারত। কিন্ত না...



আমরা সবাই গোপনে প্রেম করি। কিন্ত কখনো কোন প্রেম কি গোপন থেকেছে ? থাকেনি, কোনদিন থাকবেও না। যেমন আমারটিও আর গোপন থাকলো না। বাবা মায়ের চাপ বাড়তে থাকে। বুঝি, সে চাপ প্রেমের, সে চাপ প্রেম না করার। তাদের বাড়ীতে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আসে এবং তা মানতেই হয়। যে যাওয়া ছিলো প্রকাশ্যে, তা আড়ালে চলে যায়। মল্লিকার মা, যাকে আমি কাকী বলে ডাকতাম—তিনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন। যে কোন খাবার রান্না হলেই তিনি আমার জন্য পাঠাতেন। তার মনের ভিতর সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো—সেটা আমি বুঝতে পারতাম। তাদের একমাত্র মেয়ে, সব কিছুই ত্যাগ করতে রাজী ছিলেন। কিন্ত হলো না। ফাঁস হওয়া প্রেম বিপদ ডেকে আনে। ঐ অল্প বয়সে বিয়ের চাপ বাড়তে থাকে। মা, মামা, বন্ধুদের দিয়ে আব্বা আমাকে বোঝাতে থাকে—আমি বুঝিনা, আমি কিছুই বুঝি না, আমি শুধু তাকে বুঝি। অন্যের সাথে ওর বিয়ে হলে আমার জীবনের কোন মানে থাকে না, সেটা বুঝি। কিন্ত বাবা বোঝে না, মা বোঝে না, মামারা বোঝে না। ছন্নছাড়া হয়ে যাই। সামনে বিএ পরীক্ষা। বিয়ের চাপ বাড়তে থাকে। পাত্রীও মোটামুটি ঠিক। কিন্ত আমি রাজি না হওয়ায় বিয়ে হচ্ছে না। বার বার চাপ পড়তে থাকে। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই। বাপের সাথে প্রায় দেখাই হয় না। একা একা খাই, একা একা ঘুমাই। কিন্তু খিদে মিটে না, ঘুমও আসে না। সারারাত এপাশ ওপাশ করে শুধু রাত পার করে দেয়া। তারপর সকাল হলে অন্য কোথাও যাওয়া, বাপের নাগালের বাইরে, মায়ের নাগালের বাইরে, যেন ধরতে না পারে, বিয়ের কথা বলতে না পারে। কিন্তু বিএ ক্লাসের একজন ছাত্র যার প্রধানতম নির্ভরতার জায়গা তার বাবা—মা, সে পালিয়ে আর কোথায় যাবে ? যাওয়ার জায়গা তো সীমিত। নানা—নানীর বাড়ী, নয়তো চাচা—চাচীর বাড়ী। একসময় বাপের হাতে ধরা পড়ি। বাধ্য হই বিয়ে করতে। ইতোমধ্যে তারও বিয়ে হয়ে যায়। জীবন অল্প কিন্ত কষ্ট বিস্তর।  

সে এখন অন্য ঘরে, অন্য সংসারে, অন্য স্বরে। তার মেয়ে বড় হয়েছে। আমি কি এখনও তাকে ভালোবাসি ? এ প্রশ্ন বারবার নিজেকে করেছি, কোন উত্তর পাইনি। এই শহরের প্রান্তে প্রান্তে তার সাথে দেখা হয়। চেলোপাড়া, গালাপট্টি, সাতমাথা, জলেশ্বরীতলা, আকবরিয়া, ম্যাক্স মোটেল, সান এন্ডসি  কিংবা শ্যামলী, কোয়ালিটিতে। প্রায়ই তো বসা হয়, খাওয়া হয়, আড্ডা হয়। কিন্ত কখনো বলা হয় না— সে কী এখনো আমাকে ভালবাসে ?  মানুষের এ জীবন এত ছোট কেন? আবার কি শৈশব আসবে, আসবে কৈশোর ? সেই বয়স, প্রেম করার, ভালবাসবার। জীবনের চাকা যদি কোন রকমে সিডি’র মতো ঘুরানো যেতো, তাহলে তোমাকে আমার ঘরে বউ করে ঘরে আনতাম। আদরের বউ আমার। কেননা, তুমি যে আমার লক্ষি বউ, সোনা বউ।

লেখকঃ  ইসলাম রফিক, কবিতাকর্মী, শিল্প—সাহিত্য বিষয়ক ছোটকাগজ ‘দোআশঁ’ ও বেড়ে ওঠার কাগজ ‘নিওর’ এর সম্পাদক; সভাপতি, বগুড়া লেখক চক্র।