আমরা হাঁটতে থাকি, সকালটাকে আরো সকাল করার জন্য, সময়টাকে আরো কাছাকাছি নেয়ার জন্য। আমার সঙ্গী আবু হানিফ তিনিও হাঁটেন, পুরো এক ঘন্টা ধরে চলে আমাদের হাঁটা আর কথা। একসময় আমাদের পথ বেঁকে যায়, সোজা রাস্তা নিচে নেমে যায়, কখনো রেললাইনের পুরনো রাস্তা আমাদের কাছে নতুন হয়ে আসে। আমরা ভোর দেখি, ভোরের না ফোটা আলো দেখি, আমরা মানুষের চলাচল দেখি, কাৎ হয়ে পড়ে থাকা রেললাইন দেখি। আমরা পাখির কিচিরমিচির শুনি, আমরা পাখিদের ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখি। পাখিরাও ঘর পায়! আমরা হাঁটি, হাঁটতে হাঁটতে স্বপ্ন দেখি, কল্পনা করি, কখনো কখনো প্রত্যাশাও করি, আমাদের পায়ের নখের সাথে হোঁচট খেয়ে বেরিয়ে আসবে একটা কৌটা, যার মধ্যে থাকবে সোনা কিংবা রুপার মোহর। সেই সোনার মোহর বিক্রি করে ধীরে ধীরে বড় লোক হবো। বড়লোক হয়ে দাঁড়ালো গরিবের পাশে। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন কখনো পূরণ হয় না, সেই যে ছোটকালে পথহাঁটা শুরু, এখনও তার শেষ হলো না, মানুষের পাশে দাঁড়ানো হলো না। কারণ এখনো তো পয়সাওয়ালা বড়লোক হতে পারিনি।
হাঁটতে হাঁটতে হানিফ ভাই প্রশ্ন করে—কখনো প্রেম করেছেন ? অদ্ভুত এক শিহরণ জেগে ওঠে, এই ভোরে সূর্য যখনো আলো ছড়ায়নি, পুব আকাশের লালিমা আমার দিকে চেয়ে আছে ইশারার প্রতীক্ষায়, একদল পাখি সামনের মাঠে বিনা কারণে হাঁটাহাঁটি করে সে সময় এ প্রশ্ন আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফিরে যাই আমার বেড়ে ওঠা গ্রাম বড় সাগাটিয়ায়।
আমার প্রেমের নাম সাগাটিয়া, আমার প্রেমিকার নাম কোহিনুর। যারা আমার জীবনকে নতুন করে বুঝবার সুযোগ করে দিয়েছে। এই বোঝার মাঝে থাকে একাকীত্ব, এই বোঝার মাঝে থাকে জানা প্রেম কিংবা না জানা প্রেম। আমাদের বেড়ে ওঠা শৈশব—কৈশোর তো সাগাটিয়া গ্রামের পাথার, চরার বিল, পাট ক্ষেত দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে গল্প করা। এই সব হাঁটা, এই সব গল্প করা কিংবা শাক তোলার উসিলায় একসাথে বেড়ানো, একসাথে ফল পেড়ে খাওয়া। কোহিনুর তখন আমাদের কাছে এক প্রেরণার নাম। তার পাশে থাকা, তার সাথে চলাফেরা করা, আড্ডা দেয়া, তার ফরমাইয়েশী করার জন্য আমরা ৪/৫ জন ছেলে উঠেপড়ে লেগে থাকি। সকাল নাই, বিকাল নাই, দুপুর নাই, সন্ধ্যা নাই। প্রতিটি সময় শুধুই অপেক্ষা, আড্ডার জন্য, একসাথে বেড়ানোর জন্য, এক সাথে সাইকেল চালানোর জন্য। ওই দূরে পাল্লেগুড়া মাঠে ছাগল চরানোর জন্য আমাদের যৌথ যাত্রা, জমির ক্ষেতে পাখি তাড়ানোর নামে সকাল সন্ধ্যা যাপন। দুপুরে গোসলের নামে পুকুরে সাঁতরানো, হরি হরি খেলা, দলবেঁধে বৌচি খেলা সবকিছুরই সঙ্গী কোহিনুর।
প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে হানিফ ভাই আবার প্রশ্ন করে, প্রেমে হারিয়ে গেলেন নাকি?
আমি আলতো করে মাথা নাড়ি, ঘাড় নাড়ি। সত্যিই তো আমি হারিয়ে গেছি— শৈশবে, কৈশোরে, প্রেমে কিংবা ভাবনায়। জীবনের স্বাদ তেতো হয়ে গেছে এখন। কত স্বপ্ন নিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠা, সুখের স্বপ্ন, ভালোবাসার স্বপ্ন, সারাজীবন একসাথে কাটানোর স্বপ্ন। আমরা সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়ার শপথ নেই, আমরা ভালবাসার শপথ নেই, আমরা সারাজীবন একসাথে থাকার শপথ নেই। পাকাপোক্ত শপথ আমাদেরকে আরো গভীর করে কাছে টানে, আমরা চলনে বলনে এক হয়ে যাই, আমরা বগুড়া শহরে সিনেমা দেখতে যাই,‘প্রেমের বিরহ’ সিনেমা দেখে আমরা নিজেরা বিরহ কাতর হয়ে যাই, মেরিনা সিনেমা হল তখন আমাদের কাছে বিরহের প্রতীক হয়ে ওঠে। আমরা বাড়ী ফিরে আসি আগামীর স্বপ্ন নিয়ে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে। রাতভরে পড়ি, জোরে জোরে পড়ি, গলা ছেড়ে দিয়ে পড়ি এই আশায় যে, হয়তো জেগে থেকে কোহিনুর আমার কণ্ঠ শুনছে, আমার পড়া শুনছে। আদৌ শোনে কিনা কোনদিন জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তবুও আশায় আশায় পাঠ ।
হানিফ ভাইকে বলি, জীবনের পরতে পরতে যে স্বপ্ন থাকে এক সময় তা বিলীন হয়ে যায়, পড়ে থাকা সময় মানুষকে শুধুই কষ্ট দেয়। স্মৃতি আর প্রেম মানুষকে বড় কষ্ট দেয়। যদি প্রভু স্মৃতি আর প্রেম না দিতো তাহলে মানুষ এত বড় প্রেমিক হতে পারতো কিনা সন্দেহ। হানিফ ভাই, কথার উত্তরে মাথা নাড়ে। জিজ্ঞাসা করে আপনাদের বিয়ে হলো না কেন? সব প্রশ্নের উত্তর হয় না, সেটা বোঝাই কেমন করে? জগতে অনেক ঘটনা ঘটে কারণ ছাড়াই। কারণ থাকে না বলে, ঘটনা থেমে থাকে না—ঘটতেই থাকে। আমরা সমান তালে চলি, চলতে চলতে ব্রিজ কাছে এলে থামি, ফিরব বলে। ফেরার আগে অপেক্ষায় দু’জনই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দক্ষিণের আকাশ দেখি, ওই দূরে যে গ্রাম দেখা যায়, ফসার্ গ্রাম, ওখানকার মানুষের স্বপ্ন দেখি। কত স্বপ্ন নিয়ে মানুষ ঘুমাতে যায়, সকালে উঠে সেসব স্বপ্নের বাস্তবায়ন করবে বলে। কিন্তু সবই কি করা যায় ? যায় না। আমারও একই কারণে বিয়ে হয়নি। উত্তরটা হানিফ ভাইয়ের পছন্দ হয়েছে বলে মনে হলো না। তিনি বিস্তারিত শুনতে চেয়েছিলেন, আদ্যপ্রান্ত। স্মৃতি সেটা করতে দিলো না।
আমি বলি, বিয়েই জীবনের সবকিছু না। বিয়ে ছাড়াও জীবন চলে, বিয়ে না করেও প্রেম করা যায়, বিয়ে না করেও দিব্যি সারাটা জীবন কাটা যায়। সারা জীবনের অনেক ঘটনার মধ্যে বিয়ে একটা ঘটনা মাত্র। একটা ঘটনা মানুষের সারা জীবনের অনেক ঘটনাকে বিমর্ষ করে দেয়, ক্ষেত্র বিশেষে বিলীন করে দেয়। সুতরাং প্রেমিকার সাথে বিয়ে না হওয়াটা বড় কোন দুর্ঘটনা না। মেনে নিয়ে চলতে হয়। বরং না পাওয়া প্রেম সারা জীবন আপনাকে প্রেমে বেঁধে রাখবে, আবেগে বেঁধে রাখবে, ভালবাসায় বেঁধে রাখবে। বাড়ির দিকে এগোতে এগোতে আমি হানিফ ভাইকে কবি জীবনানন্দ দাশের ‘কুড়ি বছর’ কবিতাটি শুনায়—
আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে—
হয়তো ধানের ছড়ারর পাশে
কার্তিকের মাসে—
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে—তখন হলুদ নদী
নরম—নরম হয় শর কাশ হোগলায়— মাঠের ভিতরে।
অথবা নাইকো ধান খেতে আর;
ব্যস্ততা নাইকো আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড়ের থেকে খড়
ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি—কুড়ি বছরের পার—
তখন হঠাৎ যদি মেঠে পথে পাই আমি তোমারে আবার!
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু—সরু কালো—কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের,
ঝাউয়ের— আমের;
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!
জীবন গিয়েছে চ’লে আমাদের কুড়ি—কুড়ি বছরের পার—
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!
তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে—
বাবলার গলির অন্ধকারে
অশথের জানালার ফাঁকে
কোথায় লুকায় আপনাকে!
চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে—
সোনালি—সোনালি চিল— শিশির শিকার ক’রে নিয়ে গেছে তারে—
কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!
লেখকঃ
ইসলাম রফিক,
কবি ও সম্পাদক, লিটল ম্যাগাজিন
সভাপতি, বগুড়া লেখক চক্র।