যমুনার জলে ভেসে চলে দুই মাঝির জীবন সংগ্রামের গল্প | Daily Chandni Bazar যমুনার জলে ভেসে চলে দুই মাঝির জীবন সংগ্রামের গল্প | Daily Chandni Bazar
logo
প্রকাশিত : ৩ জুলাই, ২০২৫ ০০:৪০
যমুনার জলে ভেসে চলে দুই মাঝির জীবন সংগ্রামের গল্প
এনামুল হক, বিশেষ সংবাদদাতা:

যমুনার জলে ভেসে চলে দুই মাঝির জীবন সংগ্রামের গল্প

যমুনার ঢেউয়ের শব্দ যেন এক একটি গল্প বলে। সেই গল্পে রয়েছে ক্লান্তি, সাহস, নির্ভরতা, আর অপেক্ষার দীর্ঘ নদীপথ। এ গল্পে চরিত্র দুটি হলো রাকিবুল হাসান এবং সাজ্জাদ হোসাইন— দুই মাঝি, দুই জীবনযোদ্ধা, যারা গত ২৬ বছর ধরে তাদের জীবন পরিচালনা করে চলেছেন যমুনার বুকে।

নদীর সঙ্গে বেড়ে ওঠা:

রাকিবুল ও সাজ্জাদের জন্ম সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই নদী তাদের কাছে ছিল এক অদ্ভুত টান, যা একসময় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। প্রথমে ছিল ছোট নৌকা, পরে সময়ের সাথে সাথে তারা চালালেন বড় নৌকা, যা এখন তাদের পরিবারের রুটি-রুজির একমাত্র ভরসা।

“নৌকা মানেই শুধু বাহন নয়,” বলেন রাকিবুল হাসান। “এটা আমাদের ঘর, আমাদের সংসার।”

জীবনের সংগ্রাম:

প্রতিদিন ভোরে ঘাটে এসে নৌকা ছাড়ানোর প্রস্তুতি নেন তারা। এসময় তাদের হাতের কাজ একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে মিলে যায় যেন তারা নৌকারই অংশ। নৌকায় মাল পরিবহন করার ক্ষেত্রে, ছোট নৌকা ৫-১০ টন, মাঝারি নৌকা ১৫-৩০ টন এবং বড় নৌকাগুলি ৫০ টন বা তার বেশি বহন করতে সক্ষম। তাদের নৌকা ৪০ টন পর্যন্ত মাল বহন করে।

এমন একটি নৌকা বানাতে তাদের খরচ হয়েছে প্রায় ৭ লাখ টাকা। তবে আয়টা নির্ভর করে যাত্রার দৈর্ঘ্য ও মাল পরিবহনের ওপর। আশপাশের চরে একদিনের রিজার্ভে আয় হয় ৩,৫০০ থেকে ১০,০০০ টাকা। দূরপাল্লার যাত্রায় যেমন রংপুর-কুড়িগ্রাম বা বরিশাল, এক একটি যাত্রায় আয় হতে পারে ৫০,০০০ থেকে ৮০,০০০ টাকা পর্যন্ত।

দুঃসাহসিক যাত্রা:

তবে এই জীবনে বিলাসিতা নেই। খরচ বাদ দিয়ে দিনে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা রোজগার হয়, কিন্তু তাতেই তারা সন্তুষ্ট। “সবকিছু বাদ দিলেও শান্তি আছে এখানে,” বলে সাজ্জাদ হোসাইন, “পানি আমাদের বন্ধু। যত ক্লান্তিই আসুক, নদী কখনো ফাঁকি দেয় না।”

নৌকায় গোসল ও শৌচের ব্যবস্থা থাকলেও, তারা এসবের উপর আর গুরুত্ব দেন না। নৌকা চালাতে প্রতি দুই-তিন বছর পর সার্ভিসিং করতে হয়, এবং সেই খরচও তাদের মাথায়। কখনো হয়তো আয় কম, কিন্তু নদী কখনো তাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়নি।

নদী ও সড়ক:

তারা বলেন, “আগে ডাকাতের ভয় ছিল। মাঝরাতে নদীর মাঝপথে থেমে থাকতে হতো ভয়ে। এখন পুলিশের টহল বাড়ানোর ফলে অনেকটা কমেছে।” ডিজেলের খরচও কমেছে, এখন এক লিটারে ৪-৫ কিলোমিটার চলতে পারে।

রাকিবুল হাসান বলেন, “একটা ট্রাকে যা মাল যায়, সেই পরিমাণ বা তারচেয়ে বেশি মাল নৌকায় একবারে নেওয়া যায়। শুধু ভাড়াই না, জ্বালানি খরচেও অনেক পার্থক্য।” সাজ্জাদ হোসাইন যোগ করেন, “নৌকায় এক লিটার ডিজেলে ৪-৫ কিলোমিটার চলে। ট্রাকে তো এই খরচ দ্বিগুণের বেশি। আর নদীতে তো যানজট নেই, রাস্তাও ভাঙে না। মালিকরাও এখন বুঝে গেছে—নৌপথই লাভের পথ।”

শান্তির খোঁজে:

তুলনামূলক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম খরচ হয় রেলপথে। তার পরেই আসে নৌপথ এবং সবচেয়ে বেশি খরচ সড়ক পথে।

তবে শুষ্ক মৌসুমে নদী শান্ত হয়ে আসে, পানি কমে যায়। কিন্তু তবুও নৌকা চলে, চলতেই থাকে—যেমন তাদের জীবনও চলে। রাকিবুলের পুরো পরিবার এখন নৌকাকেন্দ্রিক জীবন যাপন করছে, পাশাপাশি তারা অন্যান্য ব্যবসাও করে থাকে।

নদীর প্রতি ভালোবাসা:

কথার ফাঁকে আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, “এই নদীর জীবন কি ক্লান্ত করে?”

রাকিবুল কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলেন, “নদী যেমন শান্ত, তেমনি রুক্ষ। তবুও এটাই ভালোবাসা। এই নদী না থাকলে আমরা থাকতাম না।”

এভাবেই যমুনার বুকে জন্ম নেয় অজস্র জীবন সংগ্রামের গল্প। রাকিবুল এবং সাজ্জাদের মতো মাঝিদের হাতেই টিকে রয়েছে নদীর নৌ-সঞ্চালন, আর তাদের জীবনজুড়ে বয়ে চলে এক নিঃশব্দ, কিন্তু শক্তিশালী নদী-গাঁথা গল্প।