
খুলনার দৌলতপুরে সাবেক যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লা (৩৮) হত্যার চার দিন পেরিয়ে গেলেও হত্যাকাণ্ডের রহস্য এখনও উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছে, স্থানীয় চরমপন্থী গ্রুপের কেউ কেউ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত হতে পারে। সেই সঙ্গে 'বহিরাগত' কিছু লোকেরও ভূমিকা থাকতে পারে, যাদের স্থানীয়রা চেনে না।
মাহবুবুর রহমান মোল্লা ছিলেন দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এবং খুলনা নগরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়া এলাকার বাসিন্দা। গত শুক্রবার দুপুরে, নিজ বাড়ির সামনে প্রাইভেট কার পরিষ্কার করার সময় একটি মোটরসাইকেলে তিনজন দুর্বৃত্ত এসে তাঁকে গুলি করে। পরে দুই পায়ের রগ কেটে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। হত্যাকারীদের একজনের মাথায় হেলমেট ছিল, যা থেকে আরও সন্দেহজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের আলামত পেয়েছে, যা হত্যাকাণ্ডের পূর্বপরিকল্পিত এবং সুসংগঠিত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
এ ঘটনায় নিহতের বাবা বাদী হয়ে দৌলতপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তে পুলিশ এখন পর্যন্ত দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য এবং এর সাথে জড়িতদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য আরও তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, "এই হত্যাকাণ্ডটি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে। মোটরসাইকেলে করে আসা তিনজন সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে, এটা নিশ্চিত। তবে, তাঁদের সঙ্গে আরও কয়েকজন ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ রয়েছে, যার সংখ্যা এখনও নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি। তদন্ত চলছে, এবং সরাসরি অংশ নেওয়া তিনজনের মধ্যে অন্তত একজনকে গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত হত্যার মূল উদ্দেশ্য জানা কঠিন।" তিনি আরও জানান, "খুনিরা প্রশিক্ষিত ও সুসংগঠিত ছিল। হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় চরমপন্থী গ্রুপের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা যেমন রয়েছে, তেমনি বাইরের লোকজনও জড়িত, যারা এলাকার কেউ চেনে না।"
এদিকে, পুলিশ, স্থানীয় বাসিন্দা এবং রাজনৈতিক সূত্রের মতে, নিহত মাহবুবুর রহমান মোল্লা দীর্ঘদিন ধরে এলাকার বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিশেষত, ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এলাকায় বিভিন্ন সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোতে তাঁর শক্তিশালী প্রভাব ছিল। একই সঙ্গে, তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় একটি নেতার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন, যা তাঁর রাজনৈতিক প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
তবে, মাহবুবুর রহমান মোল্লার আধিপত্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে তাঁর এবং স্থানীয় উঠতি সন্ত্রাসী ও চরমপন্থী গ্রুপের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। মাদক ব্যবসা এবং চাঁদাবাজির বিরোধে একাধিক পক্ষের টার্গেটে পরিণত হন তিনি, যা তাঁর হত্যার পেছনে বড় একটি কারণ হতে পারে।
দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আতাহার আলী জানান, "হত্যার পেছনে যে-যে কারণ থাকতে পারে, তা মাথায় রেখে তদন্ত চলছে। গ্রেপ্তার হওয়া সজলকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, এবং তার দেওয়া তথ্য যাচাই–বাছাই করা হচ্ছে। এছাড়া, আলাউদ্দিনের জন্য রিমান্ড আবেদন করা হচ্ছে না এখনই, তবে তাঁর কাছ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আসতে পারে। সজল ও আলাউদ্দিন হত্যাকারীদের সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করেছেন। আমরা বেশ কয়েকটি বিষয় একসঙ্গে বিবেচনায় রেখে কাজ করছি এবং আশা করছি শিগগিরই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন হবে।"
এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পুলিশ কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, খুব দ্রুতই হত্যার পেছনে থাকা ষড়যন্ত্রের সব দিক উন্মোচন হবে এবং জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।
পুলিশের দাবি ও এলাকাবাসীর বক্তব্য:
এলাকার বাসিন্দাদের মতে, মাহবুবুর রহমান মোল্লার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল ব্যাপক। তবে, তাঁর প্রতি বিদ্বেষ এবং ক্ষোভও ছিল অনেকের মধ্যে। সন্ত্রাসী, চরমপন্থী ও মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কারণে অনেকেই তাঁকে 'অবৈধ' কার্যকলাপে জড়িত হিসেবে বিবেচনা করত। এসব বিরোধ ও সম্পর্কের দ্বন্দ্বই হয়তো তাঁর হত্যার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে।
এদিকে, স্থানীয় নেতারা দাবি করছেন, এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আরও বড় কোনো সংঘাতের সূচনা হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্থানীয় নেতাদের যৌথ প্রচেষ্টায় হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উন্মোচন এবং দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি উঠেছে।