সিরাজগঞ্জে মৌসুমের শুরুতেই জমে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী জলপাইয়ের হাট। জেলার সদর উপজেলার বাগবাটি হাট এখন পাইকার ও খুচরা ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় মুখর। মৌসুমী এই ফলকে কেন্দ্র করে সপ্তাহের নির্দিষ্ট হাটবার ছাড়াও প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে কেনাবেচার মহোৎসব। কম খরচে অধিক লাভ হওয়ায় স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে জলপাই চাষের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, যা এই অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার করেছে।প্রতিদিন ভোর হতেই উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম, যেমন—সুবর্ণগাতি, হরিণা বাগবাটি, ফুলকোচা, খাগা, ঘোড়াচড়া, কানগাতি ও বান্ধমবাগ থেকে কৃষকরা অটোরিকশা, ভ্যান ও পিকআপে করে বস্তাভর্তি জলপাই নিয়ে বাগবাটি হাটে আসতে শুরু করেন। হাটের নির্ধারিত স্থানে মাটিতে পলিথিন বিছিয়ে জলপাইয়ের সবুজ স্তূপ তৈরি হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে পাবনা, নাটোর, টাঙ্গাইল, বগুড়া এমনকি রাজধানী ঢাকা থেকেও পাইকাররা এসে ভিড় জমান। দর কষাকষির পর ওজন করে জলপাই তুলে দেওয়া হয় তাদের ট্রাকে। এখান থেকেই এই জলপাই ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতিবছরের মতো এবারও জলপাইয়ের ফলন ও বেচাকেনা বেশ ভালো। প্রতিদিন এই হাটে গড়ে ৮ থেকে ১০ টন জলপাই বিক্রি হচ্ছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। পাইকারি পর্যায়ে প্রতিমণ (৪০ কেজি) জলপাই ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় কেনা হলেও, খুচরা বাজারে তা ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন, "সপ্তাহে রবি ও বৃহস্পতিবার বাগবাটিতে নিয়মিত হাট বসে। কিন্তু এখন জলপাইয়ের মৌসুম, তাই প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাট চলছে। এই কয়েক মাস আমাদের দম ফেলার ফুরসত থাকে না।আরেকজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী হাফিজুল ইসলাম, যিনি গাছ চুক্তিতে ব্যবসা করেন, তিনি বলেন, "আমরা জলপাই গাছে মুকুল আসার সময়ই বাগান মালিকদের কাছ থেকে পুরো গাছ কিনে নিই। গাছের আকার ও ফলের পরিমাণ ভেদে প্রতিটি গাছে ১০ থেকে ১৫ মণ পর্যন্ত জলপাই ধরে। তবে এ বছর বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় ফলন কিছুটা কম হয়েছে, যা দামের ওপর সামান্য প্রভাব ফেলেছে।জলপাই চাষ স্থানীয় কৃষকদের জন্য একটি আশীর্বাদস্বরূপ। এর প্রধান কারণ হলো, জলপাই চাষে তেমন কোনো পরিচর্যা বা ব্যয়ের প্রয়োজন হয় না। সার ও কীটনাশক ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা এই ফলের গাছ কৃষকদের দিচ্ছে বাড়তি আয়ের সুযোগ। এই কারণে এলাকার কৃষকরা ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি জলপাই চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।টক স্বাদের এই ফলটি নানা পুষ্টিগুণে ভরপুর। সরাসরি খাওয়ার পাশাপাশি এর প্রধান ব্যবহার আচার হিসেবে। সিরাজগঞ্জের জলপাই দিয়ে তৈরি আচার সারা দেশে বিখ্যাত। অনেক পরিবার এই আচার তৈরি করে সারা বছর সংরক্ষণ করে এবং কেউ কেউ এটিকে বাণিজ্যিক রূপও দিয়েছেন।স্থানীয় কৃষি বিভাগ জলপাই চাষের প্রসারে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা করছে। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন বলেন, "জলপাই একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল। এর আচার অত্যন্ত জনপ্রিয়। আমরা কৃষকদের জলপাই চাষে উৎসাহিত করতে এবং উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকি।"
সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ কে এম মনজুরে মওলা জানান, "সাধারণত আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ—এই তিন মাস জলপাইয়ের মৌসুম। যেহেতু এর চাষে তেমন পরিচর্যা করতে হয় না, তাই এটি কৃষকদের জন্য একটি চমৎকার বাড়তি আয়ের উৎস। আমরা জলপাইয়ের উৎপাদন কীভাবে আরও বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করছি।"
বাগবাটি হাটের এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে, সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হলে একটি মৌসুমী ফলও স্থানীয় অর্থনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।