জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সোমবার দুপুরে তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনাল এ রায় ঘোষণা করে। মামলার অপর আরেক আসামি, সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
৭৮ বছর বয়সী শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করা হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি ভারতে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই অবস্থান করছেন। পলাতক থাকায় রায়ের বিরুদ্ধে তাঁর আপিলের সুযোগ থাকবে না বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
পাঁচ অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত
মামলায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও আল–মামুনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে—
উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন,
চানখাঁরপুল ও আশুলিয়ায় আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যা,
হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণের নির্দেশ,
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে হত্যার নির্দেশ,
ড্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান শনাক্ত করে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনা।
সব অভিযোগেরই প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে রায়ে উল্লেখ করেন বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল–১।
উসকানিমূলক বক্তব্যের অভিযোগে শেখ হাসিনাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। অপরদিকে দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ায় সাবেক আইজিপি আল–মামুনের শাস্তি কমানো হয়েছে।
ফোনালাপ, জাতিসংঘ প্রতিবেদনসহ নানা প্রমাণ উপস্থাপন
সাড়ে চার শতাধিক পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তাংশ পড়তে বিচারকদের সময় লেগেছে আড়াই ঘণ্টা। আদালতে উপস্থাপন করা হয়:
শেখ হাসিনা ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের ফোনালাপ,
আন্দোলন দমনের নির্দেশের অডিও–প্রমাণ,
জাতিসংঘের জুলাই সহিংসতা বিষয়ে প্রতিবেদন,
৫৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি।
রায় ঘোষণার সময় আদালতকক্ষে উপস্থিত জুলাই आंदोलन–সংশ্লিষ্ট আহত ব্যক্তি ও নিহতদের পরিবারবর্গ আবেগে আপ্লুত হন। তবে উচ্ছ্বাস দেখে অ্যাটর্নি জেনারেল সবাইকে আদালতের পরিবেশ বজায় রাখার আহ্বান জানান।
রায়কে ঘিরে উল্লাস–নিন্দা–নিরাপত্তা জোরদার
রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও বিভিন্ন স্থানে উল্লাস করা হয়। টিএসসি এলাকায় শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে ‘ফাঁসির দাবিতে’ স্লোগান দেয়। অন্যদিকে নিষিদ্ধ রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম থাকায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আগেই ‘অনলাইন শাটডাউন’ কর্মসূচির প্রচার দেখা যায়। বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে বোমা বিস্ফোরণ ও গাড়ি পোড়ানোর ঘটনাও ঘটে।
সরকারের আহ্বান: সংযত থাকুন
অন্তর্বর্তী সরকার রায়কে “ঐতিহাসিক” অভিহিত করে জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়,
“আবেগের বশবর্তী হয়ে কেউ যেন জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত না করে। যেকোনো অরাজকতা কঠোরভাবে দমন করা হবে।”
ভারতকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানকে ফেরত দেওয়ার অনুরোধ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আশ্রয় দেওয়া “অবন্ধুসুলভ আচরণ” হবে। বাংলাদেশ–ভারত প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী তাদের ফেরত দেওয়া ভারতের “আইনি দায়িত্ব” বলেও দাবি করা হয়েছে।
মামলার প্রক্রিয়া: ৩৯৭ দিনে রায়
১৭ অক্টোবর ২০২৩: ‘মিসকেস’ হিসেবে মামলা গ্রহণ
১২ মে ২০২4: তদন্ত প্রতিবেদন জমা
১ জুন: ফরমাল চার্জ দাখিল
১০ জুলাই: আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন
আগস্ট–অক্টোবর: ৫৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ
২৩ অক্টোবর: যুক্তিতর্ক শেষে
১৭ নভেম্বর ২০২4: রায় ঘোষণা
ট্রাইব্যুনাল বলেছে, “বিশ্বের যেকোনো আদালতে এই প্রমাণ উপস্থাপন করা হলে একই সাজা হতো।”