পশ্চিমবঙ্গে ‘মোদি শাড়ি', ‘মমতা শাড়ি' কেনার ধুম
নির্বাচনের মরসুমে বাজারে এসেছে ভোটের শাড়ি। বাম-বিজেপি থেকে কংগ্রেস-তৃণমূল, বিভিন্ন দলের প্রতীক সম্বলিত শাড়ি বিক্রি হচ্ছে কলকাতার নিউ মার্কেটে। শাড়িতে রয়েছে মোদি-মমতা-রাহুলের ছবিও।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচন। এই নির্বাচন শুধুই দিল্লির ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়, ভারতবাসীর অন্যতম পার্বণও বটে। দোল-দীপাবলি-ঈদ-বড়দিন প্রতি বছর আসে, কিন্তু দেশ জুড়ে এত বড় ভোট উৎসব আসে পাঁচ বছর অন্তর। সেই উৎসব ঘিরে মেতে উঠেছে মানুষ। তার ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। বাদ যাচ্ছে না পোশাকও। বাজারে এসে গিয়েছে নতুন ডিজাইনের শাড়ি। তাতে থাকছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি প্রতীক। শাড়িতে শোভা পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী, তাঁর বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর হাসিমুখ। কলকাতার নিউ মার্কেটের দোকানে এমনই ডিজিটাল প্রিন্টের শাড়ি মিলছে। দোকানের বাইরে কাঁচের শোকেসে থরে থরে সাজানো রয়েছে ভোটের শাড়ি।
প্রতিটি শাড়িই সুন্দরভাবে ডিজাইন করা। বিজেপির পদ্ম, কংগ্রেসের হাত ও তৃণমূলের ঘাসফুল প্রতীক দেখা যাচ্ছে। কোথাও বড় মাপের প্রতীক, কোথাও ছোট ছোট অসংখ্য প্রতীকে আঁচল ভরে দেওয়া হয়েছে। কমিউনিস্টদের কাস্তে-হাতুড়িও বাদ নেই। বামপন্থি শিবিরে সেই অর্থে কোনও সর্বময় নেতা-নেত্রী নেই, তাই তাদের শাড়ি সেজে উঠেছে শুধু প্রতীকে। প্রতি শাড়িতে নির্দিষ্ট দলের রং'কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস ও তৃণমূলের ক্ষেত্রে যা সবুজ, বিজেপির ক্ষেত্রে গেরুয়া, বামেদের বেলায় আবার লাল।
নবীন ইসরানির শাড়ি বিপণী নিউ মার্কেটে আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। তাঁর দোকানে শাড়ি কিনতে এসে মহিলারা বিস্মিত হচ্ছেন ভোটের শাড়ি দেখে। এটা কি বিপণনের কৌশল? নবীন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা বিভিন্ন উৎসবে থিমের শাড়ির পসরা রাখি। দোল, দীপাবলি, পয়লা বৈশাখে সেই পার্বণের সঙ্গে মানানসই শাড়ির চাহিদা থাকে। সেভাবেই নির্বাচনের মরসুমে ভোটের শাড়ি রেখেছি। আমার দোকান ৯ বছরের পুরনো। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের সময়ও এই ধরনের শাড়ি তুলেছিলাম।''
নির্বাচনের প্রচারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দেখা যায়, প্রিয় প্রতীকে ছাপানো শাড়ি বা টি-শার্ট পরে মিছিলে হাঁটছেন। কারও মুখে থাকে পছন্দের নেতার মুখোশ কিংবা মাথায় লাল-গেরুয়া-সবুজ টুপি। ডিজাইনার শাড়ির জন্য অবশ্য মোদী-মমতার ভক্তদের একটু বেশি টাকাই খরচ করতে হচ্ছে। একেকটি শাড়ির দাম রাখা হয়েছে ভারতীয় মুদ্রায় ১,২৩০ টাকা। তবু শাড়ির চাহিদা রয়েছে। মানুষ এসে খোঁজ করছে। ক্রেতারা হঠাৎ দেখে কিনেও নিচ্ছেন।
সল্টলেকের বাসিন্দা মধুঋতা সরকারকে একটি দোকানে পাওয়া গেল। তিনি বললেন, ‘‘শাড়িগুলো খুব সুন্দর। কাপড়, ছাপা দুই-ই ভালো। দামটা একটু বেশির দিকে। তবে বেশ চমক আছে বলতেই হবে''
গড়িয়ার সমর্পিতা মজুমদার চৈত্র সেলের বাজার করতে এসেছিলেন। ভোটের শাড়ি পছন্দ হলেও তিনি দোটানায় পড়েছেন। মোক্ষম প্রশ্ন ছুঁড়ে তিনি বললেন, ‘‘বুথে গিয়ে সবার অলক্ষ্যে ভোটযন্ত্রের বোতাম টিপতে হয়। কারো বোঝার উপায় থাকে না, ভোটটা কাকে দিলাম। কিন্তু, এখানে যে শাড়িটা কিনব, সেটা দেখে অন্য দলের সমর্থকরা আমার দিকে আড়চোখে তাকাবে না?''
কলকাতার ব্যবসায়ীরা আপাতত এই সমস্যার কোনও সমাধান দিতে পারছেন না। তাঁরা বলছেন, এক-একটি দলের প্রতীক ও নেতার ছবির থিমে শাড়ি এসেছে। কিন্তু, যত মত তত পথ মার্কা শাড়ি আসেনি যেখানে এক আঁচলে সব দলের প্রতীক মিলবে, মিলবে এক ডিজাইনে মোদী-মমতা-রাহুলের ছবি। তা নাই বা হলো, যিনি যে দলের সমর্থক, সেই নেতার ছবি দেয়া শাড়ি কিনে ফেলতেই পারেন! এখানে উৎসব উদ্যাপনটাই বড় ব্যাপার।
ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিশ্বকাপ ফুটবল বা ক্রিকেটের সময় যেমন মানুষ মেতে ওঠে, ভোটে তেমনটা দেখা যায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রে এত বড় উৎসব শুরু হচ্ছে, পোশাক ছাড়া সেই উৎসব পালন করা যায় নাকি? তাই নতুন শাড়ি বাজারে আসছে। আমি মোদীজির শাড়িই বেশি দেখেছি। এটা একটা স্টাইল স্টেটমেন্ট। নাগালের মধ্যে দাম থাকলে সবাই কিনবেন, পরবেন। গণতন্ত্রের এই মহোৎসবে সামিল হওয়াটাই আসল।''
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপি কখনই তেমন উল্লেখযোগ্য শক্তি ছিল না। স্বাধীনতার পর এই প্রথমবার এখানে বিজেপি বড় শক্তি হিসেবে উঠে আসছে, এমনটাই মত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। তৃণমূল তাদের শক্তি ধরে রাখতে মরিয়া। দেশের অন্য প্রান্তে মোদী জ্যাকেট নিয়ে যে আগ্রহ দেখা গিয়েছিল, এই রাজ্যে শাড়ির বিক্রি দেখে জনপ্রিয়তার গ্রাফ বোঝা যেতেই পারে। নবীন বলেন, ‘‘মোদী-মমতার শাড়িই বেশি বিক্রি হচ্ছে। বাকিদের চাহিদা তুলনায় কম। তবে আমাদের বিক্রির কোনো টার্গেট নেই। এখানে ব্যবসা কতটা হলো, সেটা বড় ব্যাপার নয়।''
ক্রেতা থেকে বিক্রেতা, সবার কাছেই এটা সত্যিই সেলিব্রেশন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রে শ্রেষ্ঠ উৎসবের উদযাপন, যেখানে সামিল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কোটি কোটি ভারতবাসী।