দগদগে স্মৃতিতে 'চার্চ অব মিরাকল'
শ্রীলঙ্কার ইস্টার সানডে অনুষ্ঠান পালনের সময় চার্চ ও হোটেলের যেসব স্থানে বোমা হামলা চালানো হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম সেন্ট অ্যান্থনি চার্চ। ওই গির্জা সব ধর্মের মানুষের উপাসনার জন্য উন্মুক্ত হওয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়।
তবে বোমা হামলার পর সেই গির্জার দরজা এখন বন্ধ রয়েছে। একশ ৭৫ বছরের ইতিহাসে এটা বিরল ঘটনা। এর আগে কাউকে সেন্ট অ্যান্থনি চার্চের বাইরে থেকে ফিরে যেতে হয়নি। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের লোকজনের সেখানে যাতায়াত রয়েছে। খ্যাতির কারণে ওই চার্চকে বলা হয় 'চার্চ অব মিরাকল'।
কিন্তু বোমা হামলার একদিন পর সেখানকার পট পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেশজুড়ে আটটি স্থানে বোমা হামলার ঘটনায় অন্তত তিনশ জন নিহত ও বহু হতাহতের পর সেখানকার নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বোমা হামলার ঘটনায় সেন্ট অ্যান্থনি চার্চে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। হামলার সময় সেখানে বড় ধরনের জমায়েত ছিল। সাধারণত এ ধরনের অনুষ্ঠানের দিন এক হাজারের বেশি মানুষ সেখানে জমায়েত হয়। তবে বোমা হামলায় সেখানে ঠিক কতজন মারা গেছেন, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
সেন্ট অ্যান্থনি চার্চের পাশের বাসিন্দা প্রবাথ বুদ্ধিকা বলেন, আমার বাড়ি এখান থেকে কাছেই। ছোটবেলা থেকেই পরিবারের লোকজনের সঙ্গে চার্চটিতে যাতায়াত করেন বলেও জানান তিনি।
বোমা বিস্ফোরণের শব্দে অন্যদের মতো তিনিও চার্চে ছুটে আসেন। সেখানকার পরিস্থিতি সঠিকভাবে বুঝে উঠতে না পারলেও লোকজন সেখানে জমায়েত হয়েছিল সাহায্য করার জন্য।
তাদেরই একজন পিটার মাইকেল ফার্নান্দো। তিনি বলেন, চার্চের পাশেই বসবাস করেন। বিস্ফোরণের সময় তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। বিছানায় কম্পন অনুভবের পর জেগে ওঠেন। এরপর ধোঁয়া উড়তে দেখে চার্চে ছুটে আসেন।
তিনি বলেন, সেখানে অনেকের শরীর এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে পড়ে ছিল। তবে সেখানে তখনো দু'জনকে জীবিত অবস্থায় কাতরাতে দেখি। তৎক্ষণাৎ তাদের বাঁচানোর জন্য অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করি। পরিস্থিতি দেখে আমি কান্না থামাতেই পারছিলাম না।
আহত এবং নিহতদের মধ্যে বহু শিশুকে পড়ে থাকতে দেখেছেন তিনি। তিনি বলেন, তারা চিৎকার করছিল এবং তাদের শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে সাহায্যের চেষ্টা করছিলাম। আমি ছোট্ট এক মেয়েকে তুলে নিয়ে ভ্যানের দিকে যাচ্ছিলাম; ওই মেয়েটির পা উড়ে গেছে বিস্ফোরণে।
চার্চের অদূরেই থাকেন সেবিকা আনুজা সুবাসিংহি। তিনিও ছুটে এসে বহু সময় ধরে অনেককেই সেবা দিয়েছেন। আহতদের সেবা দেওয়ার সময় তিনি কান্না থামাতে পারছিলেন না। বারবার আক্ষেপ করে বলছিলেন, কারা করে এসব, কেন করে?
হামলার পর গির্জায় যারা গেছেন, প্রত্যেকের মন শুধু খারাপই হয়নি, অনেকে অঝোরে কেঁদেছেন। ওই সেবিকা বলেন, আমার স্বামী মারা গেছেন ১২ বছর আগে। কারো সাহায্যের প্রয়োজন পড়েনি তার পর। সেন্ট অ্যান্থনি চার্চই আমার জন্য যথেষ্ট।
বুদ্ধিকার মতো সুবাসিংহী বৌদ্ধ পরিবারে জন্ম নেন তবে সেন্ট অ্যান্থনি চার্চের সংস্পর্শে এসে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। সে কারণে চার্চটির প্রতি তাদের বাড়তি দুর্বলতা কাজ করে। সেখানকার অনেকেই মনে করে, ওই চার্চের আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে।
স্থানীয় অধিবাসী এবং লিখিত ইতিহাস অনুসারে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের কোচিন এলাকার ফাদার অ্যান্টোনিও ওই গির্জা নির্মাণ করেছেন। ১৮ শতকে কলম্বোতে ডাচদের শাসনামলে গোপনে তিনি খ্রিস্টধর্ম চর্চা করতেন।
মিরাকল এক ঘটনার পর তিনি চার্চ নির্মাণ করতে সক্ষম হন। সেখানকার নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছিল। লোকজন সেটা দেখে ভয় পেয়ে যায়। এরপর ফাদার অ্যান্টোনিওর কাছে এসে প্রার্থনা করতে বলেন, যাতে করে পানি বিপদসীমা অতিক্রম না করে। তিনি সে অনুযায়ী প্রার্থনা করার পর কাকতালীয়ভাবে পানির উচ্চতা হ্রাস পায়। পরে তিনি ছোট আকারে গির্জা নির্মাণ করে সেখানে সবাইকে নিয়ে প্রার্থনা করেন। জীবদ্দশায় তিনি সেখানেই কাটিয়েছেন এবং প্রার্থনা করেছেন।
স্থানীয় অনেকেই বলেন, প্রার্থনার সময় কিছু চাইলে সে ব্যাপারে অনেক সময় অলৌকিকভাবে সাড়া পাওয়া যায়। বহু মানুষের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে সেখানে প্রার্থনার পর। সে কারণে সেন্ট অ্যান্থনি চার্চ 'চার্চ অব মিরাকল' নামেও পরিচিত।