প্রকাশিত : ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১ ১৪:১৩

ট্রাম্প রাশিয়ার ‘বানানো’ প্রেসিডেন্ট, দাবি সাবেক গোয়েন্দার

অনলাইন ডেস্ক
ট্রাম্প রাশিয়ার ‘বানানো’ প্রেসিডেন্ট, দাবি সাবেক গোয়েন্দার

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রাশিয়ার সম্পদ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। চল্লিশ বছর ধরে রাশিয়ার গোয়েন্দারা তাকে গড়ে তুলেছেন এবং ২০১৬ সালে ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন, মস্কোয় তখন উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছিল।’ সম্প্রতি এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন কেজিবির সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইউরি শভেৎস।

১৯৮০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ইউরি শভেৎসকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। তিনি আসেন রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাস-এর প্রতিনিধির ছদ্মবেশে। মূলত তিনি ছিলেন কেজিবির একজন মেজর। তার দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই লেখা হচ্ছে সাংবাদিক ক্রেইগ আঙ্গারের নতুন বই ‘আমেরিকান কমপ্রোম্যাট’। ক্রেইগ এর আগে ট্রাম্প এবং পুতিনের পরিবার নিয়েও কাজ করেছেন। তার নতুন বইটিতে বিতর্কিত মার্কিন ধনকুবের জেফরি এপস্টেনের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্কও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

কেজিবির কর্মকর্তা ইউরি শভেৎস ১৯৯৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। এর কিছুদিন পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও পান। ৬৭ বছর বয়সী শভেৎস বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বসবাস করছেন। সেখানে তিনি কাজ করছেন বাণিজ্যিক নিরাপত্তা তদন্তকারী হিসেবে। এক সময় তিনি কেজিবির সাবেক গুপ্তচর আলেকজান্ডার লিটভিনেনকোর সঙ্গেও কাজ করেছেন; যিনি ২০০৬ সালে লন্ডনে গুপ্তহত্যার শিকার হন। অভিযোগ আছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশেই রাশিয়ার গোয়েন্দারা তাকে হত্যা করেছিল।

ব্রিটিশভিত্তিক গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে শভেৎস বলেন, রাশিয়ান গোয়েন্দাদের একটি কৌশল ছিল গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছার সম্ভাবনা আছে এমন সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী বা তরুণদের লক্ষবস্তু বানানো। ট্রাম্পের বিষয়টি এরকম কৌশলেরই একটি উদাহরণ। ভার্জিনিয়া থেকে ফোনে আলাপকালে গত সপ্তাহে এভাবেই বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন শভেৎস।

আঙ্গার ক্রেইগের বর্ণনায় ১৯৭৭ সালে ট্রাম্প যখন তার প্রথম স্ত্রী চেক মডেল ইভানা জেলনিকোভাকে বিয়ে করেন, তখনই তিনি রাশিয়ান গোয়েন্দাদের নজরে পড়েন। চেকস্লোভাকিয়া ও কেজিবি একসাথে তাকে নিয়ে কাজ শুরু করে। তিন বছর পর ট্রাম্প আবাসন ব্যবসায় প্রথম বড় উদ্যোগ নেন। তার প্রতিষ্ঠান নিউইয়র্কের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে গ্র্যান্ড হায়াত নিউইয়র্ক হোটেল নির্মাণ করেন। এই হোটেলের জন্য সেই সময় ট্রাম্প সেমিয়ন কিসলিন নামের এক ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০ টেলিভিশন সেট কিনেছিলেন। তিনি ছিলেন রুশ নাগরিক। নিউইয়র্কের ফিফথ অ্যাভিনিউর জয়-লুড ইলেকট্রনিকসের মালিকদের একজন ছিলেন তিনি। ইউরি শভেৎসের দাবি, জয়-লুড নিয়ন্ত্রণ করতো কেজিবি আর কিসলিন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের স্থানীয় এজেন্ট। তিনিই উদীয়মান তরুণ ব্যবসায়ী ট্রাম্পকে রাশিয়ার সম্ভাবনাময় সম্পদ হিসেবে আবিস্কার করেছিলেন। তবে কেজিবির সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছেন কিসলিন।

১৯৮৭ সালে ট্রাম্প ও ইভানা প্রথমবারের মতো মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গ ভ্রমণ করেন। ইউরি শভেৎস বলেন, সেখানে কেজিবির গোয়েন্দাদের কথায় প্রভাবিত হন ট্রাম্প। কেজিবির গোয়েন্দারাই তাকে বলেন যে, তার রাজনীতিতে যাওয়া উচিত। কেজিবির জন্য এটা একটা উপভোগ্য ব্যাপার ছিল। তারা ট্রাম্পের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেছিল। তারা জানতো তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে দুর্বল। তার এই দুর্বলতাই তারা কাজে লাগিয়েছিলেন। কেজিবির গোয়েন্দারা ট্রাম্পকে ধারণা দেন, তারা তার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ। তাদের বিশ্বাস একদিন তিনি অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন এবং তার মতো মানুষেরাই বিশ্বটাকে বদলে দিতে পারে। তাদের এমন সব প্রশংসা বাক্যে গলে গিয়েছিলেন ট্রাম্প এবং যা হবার তাই হলো।

সে সময় রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পর পরই ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। এমনকি তিনি নিউ হ্যাম্পশায়ারের পোর্টসমাউথে একটি সমাবেশও করেছিলেন। ১৯৮৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও বোস্টন গ্লোব-এর মতো সংবাদপত্রে পুরো পাতায় তার দেওয়া বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক প্রতিরক্ষা নীতির সমালোচনা করা হয়।

জাপানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে শোষণের অযৌক্তিক অভিযোগ তোলেন ট্রাম্প। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক জোট ন্যাটোয় যুক্তরাষ্ট্রের থাকারও সমালোচনা করেন তিনি। আমেরিকান জনগণের উদ্দেশে এক খোলা চিঠিতে তিনি বলেন, আমেরিকার উচিত অন্য দেশগুলোকে রক্ষা করার চেষ্টা বাদ দেওয়া এবং তাদেরকে তাদের সামর্থ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া।

ইউরি শভেৎস বলেন, ওই বিজ্ঞাপন ছিল কেজিবির জন্য একটি বড় সফলতা। তারা এটা নিয়ে খুবই উল্লসিত ছিল। এই ঘটনার কিছুদিন পর দেশে ফেরেন শভেৎস। তিনি বলেন, কেজিবির ফার্স্ট চিফ ডিরেক্টরেটের দফতরে গিয়ে আমি একটি গোপন তারবার্তা পাই যাতে ট্রাম্পের বিজ্ঞাপন নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়। এটা ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সে সময় এটা অকল্পনীয় ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রে কেউ নিজের নামে এমন একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করবে এবং সেজন্য তাকে তেমন বিরোধিতার মুখেও পড়তে হবে না!’ কিন্তু ট্রাম্প এটাই করেছেন এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও হয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে দীর্ঘ প্রায় চার দশক ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে রাশিয়া, নানাভাবে তাকে সাহায্য করা হয়েছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনেও তাকে স্বাগত জানিয়েছে মস্কো। ট্রাম্পের প্রচারশিবিরের সঙ্গে রুশ আঁতাতের বিষয়টি যদিও সরকারি তদন্তে প্রমাণিত হয়নি, কিন্তু সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেস অ্যাকশন ফান্ড নামের একটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের অনুসন্ধানে ট্রাম্পের প্রচারশিবির ও অন্তর্বর্তী দলের কমপক্ষে ২৭২ জনের রুশ-সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছিল। রুশ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের কমপক্ষে ৩৮টি বৈঠকের নিশ্চিত তথ্য তারা পেয়েছে।

ক্রেগ আঙ্গার লিখেছেন, ‘ট্রাম্পের মত আরও অনেককে নিয়েই কাজ করেছে রাশিয়া। কিন্তু ট্রাম্প ছিলেন তাদের ‘পারফেক্ট চয়েস’। অহমিকা ও বর্ণবাদী মানসিকতার কারণেই তিনি সম্ভাবনাময় ছিলেন। চল্লিশ বছরের চেষ্টার পর রাশিয়া ঠিকই নিজেদের একজন লোককে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বানাতে পেরেছে।’

উপরে