প্রকাশিত : ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২১ ১০:৫৫

সু চির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী

অনলাইন ডেস্ক
সু চির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী

ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চিকে বন্দি করার পর মিয়ানমারের ক্ষমতা এখন চলছে সামরিক শাসন। এই সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ পুরো বিশ্ব তোলপাড়, তারই মধ্যে ২০১৮ সালে সু চি তার মন্ত্রণালয়ে জেনারেলদের থাকার বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা ভালো একটা ব্যাপার।’
এর তিন বছর পর, সামরিক অভ্যুত্থানে বন্দি হলেন তিনি। এখন মনে হতে পারে সেনাবাহিনীর পক্ষে তার সেই বক্তব্য ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক কিংবা দেশপ্রেম যে কারণেই হোক না কেন, খুব খারাপ ছিল।

সু চির সমর্থকরা বলতে পারেন, তখন তিনি খুব কঠিন পরিস্থিতিতে ছিলেন এবং কঠোর ব্যবস্থা নিলে তাকে আরও আগেই জেলে যেতে হতো। কিন্তু সমালোচকরা মনে করেন, পরিস্থিতি যা-ই হোক মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি সামান্য পরিমাণে হলেও তিনি সহানুভূতি দেখাতে পারতেন।
তবে সবকিছু বিবেচনায় সু চি এবং মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন বলেই প্রতীয়মান হয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের নেত্রীর বলয় হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু মিয়ানমারের লাখ লাখ মানুষ এখনও তাকে ভালোবাসে। তার এই জনপ্রিয়তা অতিরঞ্জিত কিছু নয়।
নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি বা এনএলডি ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছে।

দেশের একটা বিশাল সংখ্যক মানুষ তাদের ‘মা সু’-কে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসে। আর চলমান পরিস্থিতিতে রাতের বেলায় এই শহরের রাস্তায় বিনাবিচারে আটক তাদের এই নেত্রীর সমর্থনে হাড়ি-পাতিল পেটানোর আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন অনেকেই।
রাতের বাতাসে এখন এই হাড়ি-পাতিলের শব্দের পাশাপাশি কিছু গানও শোনা যায়। এসব গান শোনা যেত ১৯৮৮ সালে সামরিক শাসনবিরোধী উত্তাল আন্দোলনের সময়েও। তখনই দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অং সান সু চির উত্থান ঘটে।

অং সান সু চির বাবা জেনারেল অং সান মিয়ানমারে এখনও একজন শ্রদ্ধেয় নেতা হিসেব বিবেচিত। তৎকালীন বার্মাকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করতে গিয়ে ১৯৪৭ সালে তাকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি।
আধুনিক বর্মী সেনাবাহিনীরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। এই বাহিনী ‘টাটমাডো’ নামে পরিচিত ছিল। সেই একই বাহিনী এখন তার মেয়েকে স্বাধীনতা থেকে এবং তার দেশকে তাদের নেতা থেকে আবারও বঞ্চিত করেছে।
মিয়ানমারে এর আগে ১৯৮৮ ও ২০০৭ সালে যে আন্দোলন হয়েছে (জাফরান বিপ্লব) তা ছিল মূলত রাজপথে। আর এবারের আন্দোলন হচ্ছে অনলাইনে। মূলত ফেসবুকে, যা মিয়ানমারের লাখ লাখ মানুষ সংবাদ ও তাদের মতামত আদান-প্রদানে ব্যবহার করে থাকে।

তবে এটা নির্ভর করে সেনাবাহিনী এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে রাখার ব্যাপারে কতখানি অটল থাকে তার ওপর। ইতোমধ্যে এর শক্তি টের পেয়েছে সামরিক বাহিনী। তাদের অনেক শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার ফেসবুকে নিষিদ্ধ কারণ তারা জাতীয়তাবাদী চেতনা উসকে দিতে ফেসবুকের মাধ্যমে জাতিবিদ্বেষ প্রসূত ঘৃণা ছড়িয়েছেন।
তাই এই মাধ্যমটিকে তারা এখন ভয়ও পান।

আর কারও পক্ষে বর্মী সেনাবাহিনী টাটমাডোর বর্বরতা ছাড়িয়ে যাওয়া কঠিন। স্বাধীনতা দাবি করায় তারা তাদের নিজেদের লোক, শিক্ষার্থী এবং ভিক্ষুদেরও হত্যা করেছে।
অং সান সু চি এবং তার সমর্থকদের জন্য সমস্যা হলো এই ডিজিটাল শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা।
অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি যে খোলামেলা চিঠি লিখে গেছেন তাতেও অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। কেউ কেউ ভয় পেয়েছেন যে এটা হয়তো প্রতিবাদকারীদের গ্রেফতার করার জন্য সামরিক বাহিনীরই পাতা কোনো ফাঁদ।

অং সান সু চির নামে রাজপথে নেমে আসার ঘটনা হয়তো সারা বিশ্বের সোশাল মিডিয়া ও টেলিভিশন সংবাদের কাছে পরিষ্কার ছবি ও শক্তিশালী বার্তা পাঠাতে পারে। কিন্তু ১৯৮৮ সালে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নে রক্তে ভেসে গিয়েছিল রাজপথ।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, এমন বর্বরতা আবারও চালাতে পারে মিয়ানমারের সেনারা।
দেশটির সর্বশেষ পরিস্থিতিতে আরেকটি বিষয় আছে যা আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও সত্য-বর্জিত নয়।
অং সান সু চির মুক্তি পাওয়ার সুযোগ এবং ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা নির্ভর করছে ‘আন্তর্জাতিক সমাজ’ কী করে, তার ওপর।

পশ্চিমা বিশ্বের কাছে সু চি ছিলেন আজীবনের প্রেসিডেন্ট। নির্বাচিত নেতারা যেসব মূল্যবোধের কথা বলে থাকেন তিনি যেন ছিলেন তাদের কাছে সেরকমই এক আলোকবর্তিকার মতো। তবে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করা অথবা তাদেরকে সমর্থন দিতেও অস্বীকৃতি জানানোর কারণে পরে তিনি তাদের কাছ থেকে তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছেন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান তাকে দেওয়া সম্মান, পুরস্কার, উপাধি প্রত্যাহার করে নেয়ার পরেও তিনি বিচলিত হননি।

এই সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যাওয়ার একটি উদাহরণ হিসেবে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরা যেতে পারে। অং সান সু চির ১৫ বছর গৃহবন্দি থাকার সময়ে বিবিসি ছিল তার বিশ্বস্ত সঙ্গী। তবে ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে বর্বরতার পর সবকিছু বদলে গেছে।

অন্যান্য পশ্চিমা মিডিয়ার মতো বিবিসিও তার সাক্ষাৎকার গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে বারবার চিঠি পাঠিয়েও কোনো উত্তর পায়নি।

সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের ক্ষোভ থাকার পরেও দেশের ভেতরে সু চির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের সম্মান রক্ষা করার কারণে তিনি প্রশংসিতও হয়েছেন। কিন্তু এখন অনেকেই বিশ্বাস করেন সামরিক স্বৈরশাসনের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যে আন্দোলন শুরু হতে যাচ্ছে তাতে অং সান সু চির প্রতীক হয়ে ওঠার কোনো কারণ নেই।

অং সান সু চির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তাতে তার কারাদণ্ড হতে পারে। এর ফলে তিনি হয়তো নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না, এমন পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে।
জেনারেলরা বলছেন, জরুরি অবস্থা শেষ হওয়ার পর দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
নিক বিক মনে করেন, সামরিক বাহিনী দেশটির নির্বাচনী ব্যবস্থায় একটা ক্ষতিসাধন করতে চায়।
কিন্তু অং সান সু চি যদি মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছর কারাবন্দি থাকেন তাহলে কী হবে?
মিয়ানমারের নেত্রীর ২০ বছরের সাবেক বন্ধু রিচার্ডসন বলছেন, ‘আমার মনে হয় তিনি অনুধাবন করতে পারবেন যে সামরিক বাহিনী, যাদেরকে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন, তারা তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তার অবস্থা খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন। তবে আমি আশা করি তারা তার ক্ষতি করবে না অথবা তাকে চিরকালের জন্য চুপ করিয়ে দেবে না।’
আর অং সান সু চিকে যদি আবার কথা বলার অনুমতি দেয়া হয় তখন?

‘তিনি যদি আবার কথা বলতে পারেন এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ করা হয়েছে সেগুলো স্বীকার করে নেন, তাহলে আন্তর্জাতিক সমাজ তাকে বিশ্বাসযোগ্য ও সৎ বলে মনে করবে। এখনও খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি। তখনই বিশ্ব সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াবে।’
‘এটা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তবে আগেও তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন।’

 দৈনিক চাঁদনী বাজার/সাজ্জাদ হোসাইন

উপরে