প্রকাশিত : ৪ মার্চ, ২০২১ ১৩:২১

জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের সংখ্যা কমাতে অভিনব পন্থা চীনের

অনলাইন ডেস্ক
জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের সংখ্যা কমাতে অভিনব পন্থা চীনের

চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের হাজার হাজার উইঘুর এবং আরও নানা জাতিগত সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমাতে অভিনব পন্থা অনুসরণ করছে চীন। এসব সংখ্যালঘুদের নিজেদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে কাজের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছে চীনা কর্তৃপক্ষ। ফলে উইঘুর এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের আদি আবাসভূমিতে তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। খবর বিবিসির।

চীনে উচ্চ পর্যায়ের একটি জরিপ থেকে এসব তথ্য জানতে পেরেছে বিবিসি। এর মধ্যে দিয়ে চীনের পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অনুপাত বদলে দেবার চেষ্টা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে সরকার তা অস্বীকার করছে।

চীন সরকারের দাবি, গ্রামীণ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা বেকারত্ব এবং দারিদ্র দূর করার লক্ষ্যে মানুষের আয় বাড়াতেই এসব চাকরি ও বদলির পরিকল্পনা করা হয়েছে।

কিন্তু বিবিসির পাওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণে আভাস পাওয়া গেছে যে, এই নীতিতে জোর খাটানোর উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে এবং গত কয়েক বছরে জিনজিয়াং প্রদেশ জুড়ে যেসব শিবির গড়ে তোলা হয়েছে তার পাশাপাশিই এসব চাকরিগুলোর পরিকল্পনা করা হয়েছে সংখ্যালঘুদের জীবনধারা ও চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনার জন্য।

এই জরিপটি আসলে শুধু চীনের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরই দেখার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনাবশত তা অনলাইনে প্রকাশ হয়েছে। চীনের প্রপাগাণ্ডা রিপোর্ট, সাক্ষাতকার এবং বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শনের ওপর ভিত্তি করে বিবিসি যে অনুসন্ধান চালাচ্ছে -তার একটি অংশ হচ্ছে এই জরিপ।

উইঘুর শ্রমিকদের বদলির সাথে দুটি বড় পশ্চিমা ব্র্যান্ডের সংযোগ নিয়ে বিবিসি প্রশ্ন তুলেছে। কারণ এ ব্যাপারটা ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ছে।

২০১৭ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত টিভি চ্যানেলে একটি ভিডিও রিপোর্ট প্রচারিত হয়। ওই রিপোর্টটি ২০১৭ সালে প্রচারিত হলেও এখন পর্যন্ত কোন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এটি দেখানো হয়নি।

এতে দক্ষিণ জিনজিয়াংয়ের একটি গ্রামের কেন্দ্রস্থলে একদল সরকারি কর্মকর্তাকে একটি লাল ব্যানারের সামনে বসে থাকতে দেখা গেছে।ব্যানারে দেখা যাচ্ছে -আনহুই প্রদেশে কিছু চাকরির বিজ্ঞাপন। আনহুই প্রদেশ জিনজিয়াং থেকে চার হাজার কিলোমিটার দূরে।

পুরো দু’দিন পার হওয়া পরই এই গ্রাম থেকে একজনও এসব চাকরির ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। তখন কর্মকর্তারা বাড়ি বাড়ি যেতে শুরু করেন।

এরপর একটি ভিডিওটিতে দেখা গেছে কিভাবে চীনের উইঘুর কাজাখ ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ব্যাপকভাবে শ্রমিক হিসেবে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বেশির সময়ই তাদের বাড়ি থেকে বহু দূরে নিয়ে যাওয়া হয়।

ভিডিওতে কর্মকর্তারা কথা বলছেন একজন বাবার সাথে যিনি স্পষ্টভাবেই চান না যে তার মেয়ে বুজায়নাপ এতো দূরে চাকরি করতে যাক।
তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই এমন অন্য কেউ আছে যে যেতে চায়। আমরা তো এখানেই উপার্জন করতে পারছি । আমাদের এই জীবন নিয়েই থাকতে দিন।’

তখন কর্মকর্তারা সরাসরি ১৯ বছর বয়স্ক বুজায়নাপের সাথে কথা বলেন। তাকে বলা হয়, সে যদি এখানে রয়ে যায়, তাহলে কয়েকদিন পরেই তার বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে এবং আর কখনো সে এ জায়গা ছাড়তে পারবে না।

চীনা কর্মকর্তারা তাকে বলেন, চিন্তা করে দেখুন, আপনি কি যাবেন? রাষ্ট্রীয় টিভির সাংবাদিক এবং সরকারি কর্মকর্তাদের তীক্ষ্ম নজরের সামনে বুজায়নাপ মাথা নাড়লেন। তার পর বললেন, ‘আমি যাবো না।’

কিন্তু তারপরও চাপ দেয়া হতে থাকল এবং শেষ পর্যন্ত বুজায়নাপ কাঁদতে কাঁদতে রাজি হলেন। বললেন, ‘আমি যাবো যদি অন্যরাও যায়।’
ভিডিওটি শেষ হচ্ছে মা’র কাছ থেকে মেয়ের অশ্রুভেজা বিদায় নেবার মধ্যে দিয়ে। বুজায়নাপ এবং অন্যরা তাদের পরিবার এবং সংস্কৃতি পেছনে ফেলে রেখে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।

গ্রাম থেকে বিদায়ের তিন মাস পর বুজায়নাপকে আরেকটি টিভি অনুষ্ঠানে দেখা গেছে। সরকারি টিভির ওই রিপোর্টে দেখা গেছে তিনি আনহুইতে হুয়াফু টেক্সটাইল কোম্পানিতে কাজ করছেন।

একটি ভিডিওতে বুজায়নাপকে তার ভুলের জন্য বকাঝকা করা হচ্ছে এমন একটি দৃশ্য দেখানো হয়েছিল। তবে পরে তার সম্পর্কে বলা হয়, ‘এই ভীতু মেয়েটি আগে মাথা তুলে কথা বলতে পারতো না, কিন্তু এখন কাজে সে কর্তৃত্ব দেখাতে পারছে। জীবনধারা পাল্টাচ্ছে, চিন্তাতেও পরিবর্তন আসছে।’

মানবাধিকার ও সমকালীন দাসত্ব বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হলেন শেফিল্ড হাল্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লরা মার্ফি। তিনি ২০০৪ থেকে শুরু করে বহুবার জিনজিয়াংয়ে গেছেন এবং কিছুদিন থেকেছেন।

তিনি বলেন, ‘ভিডিওটা সত্যি চমকপ্রদ। চীনা সরকার সবসময়ই বলছে যে, লোকেরা স্বেচ্ছায় এসব কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছে। কিন্তু এই ভিডিওতে স্পষ্টভাবে বেরিয়ে এসেছে যে, এটা এমন এক পদ্ধতি যেখানে জোর খাটানো হচ্ছে এবং কাউকে এতে বাধা দিতে দেয়া হচ্ছেনা।’

তার মতে, এই ভিডিতে অন্য যে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো অসাধু উদ্দেশ্য । যদিও বলা হচ্ছে মানুষের দারিদ্র মোচনের কথা, কিন্তু এখানে মানুষের জীবনকে বদলে দেয়া হচ্ছে, পরিবারগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে, জনগোষ্ঠীকে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে নানা জায়গায়, বদলে দেয়া হচ্ছে তাদের ভাষা, পরিবারকাঠামো - যা আসলে দারিদ্র কমানোর চাইতে বরং বাড়িয়ে দিতে পারে।

বেইজিংয়ে ২০১৩ সালে এবং কুনমিংয়ে ২০১৪ সালে পথচারী ও পরিবহনে যাত্রীদের ওপর দুটি নৃশংস আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল। এসব হামলার জন্য উইঘুর ইসলামপন্থী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দায়ী করা হয়।

সেই থেকেই জিনজিয়াংয়ে চীনা নীতির পরিবর্তনের সূচনা। চীনা প্রতিক্রিয়ার একদিকে ছিল বন্দীশিবির প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে চাকরির বদলি কর্মসূচি।

এর মূল কথা ছিল, উইঘুরদের সংস্কৃতি ও ইসলামিক বিশ্বাসকে পরিবর্তন করে তার জায়গায় আধুনিক বস্তুবাদী পরিচয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্য চাপিয়ে দেয়া। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে উইঘুরদের চীনা হ্যান সংস্কৃতির অংশ করা।

চীনা রিপোর্টটি ২০১৯ সালে ভুলবশত অনলাইনে প্রকাশ করে দেয়া হয়। তবে কয়েক মাস পরে আবারও মুছে দেয়া হয়। নানকাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষাবিদের লেখা প্রতিবেদনে গণহারে শ্রমিকদের বদলিকে-উইঘুরদের চিন্তায় পরিবর্তন আনা এবং তাদের প্রভাব বিস্তার করে বাকি সমাজের সাথে যুক্ত করাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

উইঘুরদের চীনের অন্যত্র নিয়ে গেলে জনঘনত্ব কমবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। ভিক্টিম অব কমিউনিজম মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের ড. এ্যাড্রিয়ান জেঞ্জ এই প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করেছেন।

তিনি একে নজিরবিহীন বলে বর্ণনা করেছেন। তার বিশ্লেষণে আইনী মতামত দিয়েছেন এরিন ফ্যারেল রোজেনবার্গ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হলোকস্ট মিউজিয়ামের সাবেক উপদেষ্টা। তিনি বলছেন, নানকাই রিপোর্টটি জেরপূর্বক উচ্ছেদ ও নিপীড়নের মত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি তৈরি করেছে।

এ ব্যাপারে এক প্রতিক্রিয়ায় চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, এই প্রতিবেদনে লেখকদের নিজস্ব মতামত প্রতিফলিত হয়েছে এবং এর সারবস্তুর অনেক কিছুই ‘বাস্তবসম্মত নয়।’

প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিবেদনের সর্বত্রই কড়া নিয়ন্ত্রণের চিহ্ন দেখা গেছে। নতুন চাকরিপ্রাপ্তরা শুরু থেকেই কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাপনার অধীনে চলে যায়। কখনো কখনো পূর্ব চীনের স্থানীয় পুলিশ ট্রেন ভর্তি উইঘুরদের দেখে এতই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে তাদের ফেরত পাঠানো হয়।

প্রতিবেদনের কোথাও কোথাও সতর্ক করা হয়েছে যে, জিনজিয়াংয়ের ক্ষেত্রে চীনের নীতি হয়তো বেশি কঠোর হয়ে গেছে-যেমন পুনঃশিক্ষা কেন্দ্রে যে পরিমাণ লোক আছে তা উগ্রপন্থার সাথে জড়িত এমন সন্দেহভাজনের চেয়ে অনেক বেশি। পুরো উইঘুর জনগোষ্ঠীকেই দাঙ্গাবাজ বলে ধরে নেয়াটা ঠিক হবে না বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অনুসন্ধানের সময় সাংবাদিকরা কিছু কারখানায় উইঘুর শ্রমিকদের ওপর কিছু বিধিনিষেধের তথ্য পেয়েছেন।একটি কারখানার উইঘুর শ্রমিকদের একেবারেই বেরোতে দেয়া হয় না বলেও অভিযোগ উঠেছে।

দৈনিক চাঁদনী বাজার  / সাজ্জাদ হোসাইন

 

উপরে