প্রকাশিত : ৯ জুলাই, ২০২১ ০৮:৫৮

প্রেসিডেন্ট হত্যার পর গভীর সংকটে হাইতি

অনলাইন ডেস্ক
প্রেসিডেন্ট হত্যার পর গভীর সংকটে হাইতি

হাইতির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে অস্থির। এর মধ্যে গত বুধবার নিজ বাড়িতে বন্দুকধারীদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়িজ। ফলে আগে থেকেই অশান্ত ক্যারিবীয় দেশটির পরিস্থিতি আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

২০১৫ সালে হাইতির সাধারণ নির্বাচনে জিতেছিলেন ময়িজ। কিন্তু সেটি বাতিল করে তাকে ফের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। ময়িজ সেখানেও জেতেন। অবশেষে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি। দায়িত্ব নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন ৫৩ বছর বয়সী এ নেতা। তবে শাসনকাল খুব একটা সুখের হয়নি তার।

সমালোচকদের অভিযোগ, ক্ষমতায় বসার পর থেকেই ময়িজ একনায়কের মতো আচরণ শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, অপশাসন, দুর্নীতির অভিযোগ আনেন বিরোধীরা। এমনকি, ময়িজ সংবিধানে পরিবর্তন এনে আরেক দফায় প্রেসিডেন্ট হতে চান বলেও সন্দেহ করা হচ্ছিল। এগুলো নিয়ে তার বিরুদ্ধে দফায় দফায় বিক্ষোভ হয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সংসদ ভেঙে দেয়ার পর থেকে ডিক্রি জারির মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করছিলেন জোভেনেল ময়িজ।

গত ফেব্রুয়ারিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ব্যাপক সহিংস রূপ নেয়। সেই সময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে ময়িজ জানিয়েছিলেন, তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে অন্তত সাতবার চেষ্টা করা হয়েছে। একই মাসে ময়িজ আরও জানিয়েছিলেন, তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে এবং এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে অন্তত ২০ জন গ্রেফতার হয়েছেন। পরে অবশ্য ময়িজের অভিযোগ খারিজ করে একটি আপিল আদালত গ্রেফতার ব্যক্তিদের মুক্তি দেয়। এদের মধ্যে একজন বিচারক ও পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ছিলেন।

গত বুধবার হাইতির রাজধানী পোর্ট অ-প্রিন্সে ময়িজের বাড়িতে ঢুকে হামলা চালায় একদল বন্দুকধারী। তাদের গুলিতে প্রাণ হারান হাইতির প্রেসিডেন্ট। গুরুতর আহত হয়েছেন তার স্ত্রী মার্টিন ময়িজও।

প্রেসিডেন্ট ময়িজকে কারা হত্যা করেছে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ক্লোদ জোসেফ বলেছেন, হত্যাকারীরা উচ্চ প্রশিক্ষিত। তাদের কয়েকজন স্প্যানিশ ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলছিল। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত হাইতির রাষ্ট্রদূত বোচিত এডমন্ড হামলাকারীদের ‘পেশাদার কমান্ডো’ ও ‘বিদেশি ভাড়াটে গুণ্ডা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। হামলাকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের এজেন্টের বেশ ধরেছিল বলেও জানান তিনি।

প্রেসিডেন্ট হত্যাকাণ্ডের পরপরই দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর হাইতির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে সন্দেহভাজন চার হত্যাকারী নিহত এবং দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে তাদের পরিচয় বা প্রেসিডেন্টকে হত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি।

হাইতির রাজনৈতিক অস্থিরতার ইতিহাস অবশ্য নতুন নয়। ১৯৫৭ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ফ্রাঁসোয়া ডুভালিয়ে ও তার ছেলে জ্যঁ ক্লোদ ডুভালিয়ের শাসনামল শেষ হওয়ার পর থেকে দেশটিতে বহুবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে চরম দারিদ্র্য এবং সন্ত্রাস। শুধু চলতি বছরেই ক্রিমিনাল গ্যাংদের কারণে সেখানকার হাজার হাজার মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

ইউনিসেফে হাইতির প্রতিনিধি ব্রুনো মাস গত মাসে হাইতির পরিস্থিতিকে গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। হাইতির ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ডিফেন্স নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক পিয়ের এসপেরাঁস জানিয়েছেন, দেশটির প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা বিভিন্ন ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ চলে। এসব গ্যাং প্রায়ই পুলিশ ও সেনা সদস্যদের ওপর হামলা চালায়।

এ অবস্থায় গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে হাইতিতে রাজনৈতিক বিরোধ বাড়তে শুরু করে। বিরোধীরা দাবি করেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ময়িজের মেয়াদ শেষ। কিন্তু ময়িজের যুক্তি ছিল, তিনি ২০১৫ সালে নির্বাচনে জিতলেও শপথ নিয়েছেন ২০১৭ সালে, সুতরাং তার মেয়াদ শেষ হবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপরও বিরোধীদের দাবির মুখে আগামী সেপ্টেম্বরে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট।

এর মধ্যে গত এপ্রিলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জোসেফ জুট পদত্যাগ করেন। এরপর ক্লদ জোসেফকে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী করা হয়। তবে খুন হওয়ার মাত্র একদিন আগে আরিয়েল হেনরিকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ময়িজ। কিন্তু সেটি চূড়ান্ত করতে পারলেন না তিনি।

প্রেসিডেন্ট মারা যাওয়ায় হাইতির সংবিধান অনুযায়ী দেশপরিচালনার ভার সুপ্রিম কোর্টের সভাপতির নেয়ার কথা। কিন্তু সম্প্রতি তিনি করোনায় মারা গেছেন। ফলে নতুন নেতা হিসেবে একজনকে নির্বাচিত করার কথা জাতীয় পরিষদের। তবে সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ বর্তমানে দেশটিতে কার্যকর কোনো জাতীয় পরিষদ নেই। নিম্নকক্ষের সব সদস্য ও সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যেরও মেয়াদ শেষ। ফলে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী জোসেফকেই এখন কাজ চালিয়ে যেতে হতে পারে।

সূত্র: ডয়েচে ভেলে, সিএনএন

দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন

উপরে