শ্রীলঙ্কার খাদ্য সংকট ‘মানবসৃষ্ট’

শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সারের অভাবে ফসল ফলাতে না পেরে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ৪৯ বছর বয়সী কৃষক মাহিন্দা সামারউইক্রেমা এই মৌসুমে ধান রোপণ করতে পারছেন না। লঙ্কান সরকার রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করায় গত মার্চেও এই কৃষকের আট হেক্টর জমিতে ধান ও কলা চাষের পরিমাণ অর্ধেক কমে গেছে। মাহিন্দা বলেন, তার আর একটি কৃষি খামারও ধরে রাখার মতো আয় নেই।
দক্ষিণাঞ্চলের হাম্বানটোটা জেলার পাঁচ সন্তানের জনক মাহিন্দা এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে জানিয়েছিলেন, তিনি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাগানে চাষ করা একটি কলা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলছিলেন, আমি যখন এটা দেখি তখন জানি যে স্বাভাবিক ফলনও আমি পাবো না।
বছরের এই সময়ে, সামারাউইক্রেমার বেশিরভাগ গাছের উচ্চতা দ্বিগুণ হয় এবং ফুলও ফোটে। কিন্তু এবার আগাছা-ছড়ানো মাঠের এক হাজার তিনশ গাছের মাত্র কয়েকটিতে ফুল ধরেছে। এই কৃষক বলেন, তিনি বছরে ৩৭ হাজার কেজি (৮১ হাজার ৫৭১ পাউন্ড) কলা পেতেন কিন্তু এবার তিনি আশা করছেন মাত্র ৬ হাজার (১৩ হাজার ২২৮ পাউন্ড) কেজি কলা পেতে পারেন। সবকিছু ভেঙে পড়েছে উল্লেখ করে শ্রীলঙ্কার এই কৃষক বলেন, আমি কি করবো জানি না, তবে আকাশের দিকে এবং মাটির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছি।
সামারাউইক্রেমার ওয়ালসাপুগালা গ্রামের অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষক বলছেন যে, তারা চলতি মৌসুমে তাদের ক্ষেতে সেচ দেবেন না। এই মৌসুম মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত চলে এবং ইয়ালা নামেও পরিচিত। তারা বলেন যে, সার আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে ফসলের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে এবং দেশব্যাপী জ্বালানির ঘাটতিও চাষকে অসহায় করে তুলছে।
‘এখন আর চাষ করে লাভ নেই, বলেন কেএ সুমনদাসা। তিনি তার এক হেক্টর (শূন্য দশমিক ছয়-একর) জমিতে বেগুন চাষ করেন। ৭০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ শাকসবজির একটি ব্যাগ থেকে অনেকগুলো ছত্রাকযুক্ত ফসল বের করে বলেন, অর্গানিক কৃষিতে স্থানান্তরের ফলে তার ফলন প্রতি মৌসুমে ৪০০ কেজি (৮৮২ পাউন্ড) থেকে ৫০ কেজিতে (১১০ পাউন্ড) নেমে এসেছে।
সুমনদাসা বলেন, তার খামারে যে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তা তিনি পুনরুদ্ধার করতে পারবেন না। তিনি আরও বলেন, আমি এখন চাষের ঝুঁকি নিতে পারি না। আমি কেবল আমার পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য চাষ করবো।
ভূমি ও কৃষি সংস্কার আন্দোলন (এমওএনএলএআর) নামে একটি বেসরকারি সংগঠন বলছে, হাম্বানটোটা জেলায় এবং উত্তরের প্রধান কৃষি অঞ্চলে যেমন অনুরাধাপুরা ও পোলোনারুওয়া জেলার অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষকরাও এই মৌসুমে চাষাবাদ বন্ধ করে দিচ্ছেন।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে এই সংকট যেখানে দেশটি এরই মধ্যে আমদানি করা খাদ্যসামগ্রীর ঘাটতির সঙ্গে লড়াই করছে। এখন অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত খাদ্যেরও ব্যাপক ঘাটতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার কাউন্সিল ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ পলিসির প্রেসিডেন্ট গামিনি সেনানায়েকে বলেন, খাদ্যের দিক থেকে আগামী কয়েক মাসে খুব কঠিন সময় আসবে। খাদ্য ঘাটতি হবে... আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা এক সময় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। কিন্তু সার ও কীটনাশকসহ সব ধরনের কৃত্রিম কৃষি রাসায়নিক পণ্য নিষিদ্ধ করেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। দেশকে সম্পূর্ণরূপে জৈব কৃষিতে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল তার। এটিই শ্রীলঙ্কার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। গত বছরের মে মাসে রাতারাতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল গোতাবায়ার সরকার।
২০ লাখ কৃষক যারা দেশটির শ্রমশক্তির ৩০ শতাংশ এবং যারা তখন পর্যন্ত ভর্তুকিযুক্ত রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল, হঠাৎই বিপাকে পড়েছেন। তারা বলছেন, সরকার জৈব সারের উৎপাদন বাড়ায়নি বা তাদের চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত মাটির পুষ্টি উপাদানও আমদানি করেনি। যার ফলশ্রুতিতে গত মার্চের শেষের দিকে কৃষি উৎপাদনে নাটকীয় পতন ঘটে যা স্থানীয়ভাবে মহা মৌসুম হিসেবে পরিচিত। মহা ফসলের জন্য সরকারি পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও বিশেষজ্ঞরা ফসলের উপর নির্ভর করে ২০ থেকে ৭০ শতাংশ উৎপাদন হ্রাস পায় বলে ধারণা করেন।
প্রধান উৎপাদিত ফসল ধানের উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। যার ফলে চলতি বছর সরকার তিন লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করে। যেখানে ২০২০ সালে আমদানি করে ১৪ হাজার মেট্রিক টন। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে সরকার জ্বালানি ও ওষুধসহ প্রয়োজনীয় আমদানির জন্য অর্থ প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। ঘাটতির কারণে আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি, ডিজেলের জন্য দীর্ঘ সারি, ১৩ ঘন্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, এ ধরনের সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে দেশটিতে।
শ্রীলঙ্কার এমন দুর্দশার জন্য সরকারি অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে এবং রাজাপাকসে ও তার প্রতাপশালী ভাইদের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবিতে কয়েক হাজার মানুষ রাস্তায় নামেন। বিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্টের ভাই বাসিল রাজাপাকসে ও চামাল রাজাপাকসে, একই সঙ্গে নামাল রাজাপাকসে গত মার্চ মাসে মন্ত্রিসভা ছেড়ে দেন। এরপর আন্দোলনের চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্টের ভাই ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। যদিও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া বহাল তবিয়তে আছেন এবং তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। বরং অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য করোনা মহামারি, ঋণের বোঝা ও পর্যটন খাতে ধসের মতো অজুহাত দেখানো হয়।
গত এপ্রিলে কৃষিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত জনকা ওয়াককুম্বুরা মে মাসের শুরুতে বলেন যে, জৈব কৃষিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত আসলে দ্রুত নেওয়া হয়েছে এবং আমরা ত্রুটিগুলো বুঝতে পেরেছি। শিগগির কৃষকদের প্রয়োজনীয় সার সরবরাহ করার কথাও বলেন তিনি। কিন্তু এপ্রিলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ১৮০ কোটি ডলারে। এ ছাড়া রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের কারণে বিশ্ববাজারে সারের দাম বেড়ে যায়।
শ্রীলঙ্কার কৃষি বিভাগের সাবেক শীর্ষ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লিওনেল ওয়েরাকুন বলেন, সরকারি ও বেসরকারিভাবে ২০২০ সালে সার আমদানিতে প্রায় ২৫৯ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে রাশিয়া, বেলারুশ ও চীনের সার রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে। তিনি বলেন, যদি আমরা ২০২০ সালের মতো একই পরিমাণ সার কিনতে চাই, তাহলে আমাদের ৬০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা সামনে শ্রীলঙ্কার সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি, যা বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশে রয়েছে, তা আরও বাড়তে পারে।
শ্রীলঙ্কার পেরাদেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের অধ্যাপক জিউইকা ওয়েরাহেওয়া বলেন, খাদ্য সংকট বড় আকার ধারণ করছে। শ্রীলঙ্কার এই খাদ্য সংকটকে ‘মানবসৃষ্ট’ বলেও অভিহিত করেন তিনি। পরবর্তী চার অথবা ছয় মাস শ্রীলঙ্কার জন্য আরও কঠিন সময় বলেও সতর্ক করেন এই অধ্যাপক।
সূত্র: আল-জাজিরা
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন