বলিউডের পর এবার কি ভারতীয় ক্রীড়া জগতেও ঘটতে যাচ্ছে মি টু আন্দোলন?
ভারতের রেসলিং (কুস্তি) ফেডারেশনের কর্মকর্তা ও কোচদের বিরুদ্ধে নারী রেসলারদের (কুস্তিগীর) যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ বেশ পুরোনো। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে সে আগুনে যেন ঘি ঢালা হয়েছে। বছরের প্রথম মাসেই দেশটির শীর্ষ কুস্তিগীরদের তোপের মুখে পড়েছে ফেডারেশন।
জানুয়ারির ১৮ তারিখ থেকে একের পর এক নারী কুস্তিগীর নিজেদের অপ্রীতিকর সব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে থাকেন। সেদিন অলিম্পিক ও কমনওয়েলথ গেমসের পদক বিজয়ী রেসলার ভিনেশ ফোগাটসহ কয়েকজন বিখ্যাত নারী কুস্তিগীর রেসলিং ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার অফিসে সংগঠনটির প্রধান, কতিপয় কর্মকর্তা ও কোচদের অসদাচরণের নিন্দা জানাতে জড়ো হন।
দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভিনেশ ফোগাট যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলার পর বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়। একপর্যায়ে অন্তত ১০ নারী কুস্তিগীর স্বীকার করেন, তারা ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ব্রিজ ভূষণ সিংয়ের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
যদিও ভূষণ সিং নারী কুস্তিগীরদের অভিযোগগুলো রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, কয়েকজন খেলোয়াড় নিজেদের ‘অতিরিক্ত উদ্দেশ্য’ হাসিলের জন্য অন্যদের দিয়ে এমন কাজ করাচ্ছেন। তার এমন মন্তব্যে সম্মিলিত প্রতিবাদ আরও বড় হয়। চাপে পড়ে যান রেসলিং ফেডারেশনের সভাপতি ও রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপির) আইনপ্রণেতা ভূষণ সিং।
কয়েকদিন পর কেন্দ্রীয় সরকার ভূষণ সিংকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করে ও ফেডারেশনের কার্যক্রম তদারকির জন্য একটি প্যানেল গঠন করে। ভারতীয় অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন ভূষণ সিংয়ের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি কমিটিও গঠন করেছে।
এদিকে, বিক্ষোভ আপাতত বন্ধ হলেও সমস্যাটি শিগগিরিই শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলছেন অনেকে। কুস্তিগীররা এখন বলছেন, তদারকি প্যানেল গঠনের আগে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি। সুতরাং এটির প্রতি তারা বিশ্বাস রাখতে পারেন না।
যোগাযোগ করা হলে ভিনেশ ফোগাট বলেন, আমি যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আর কথা বলতে চাই না। তবে আমরা সঠিক ব্যবস্থা নেবো ও সঠিক সময়ে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করবো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলোয়াড়-ক্রীড়াবিদদের এ ধরনের আন্দোলন বা ঐক্য ক্রীড়া সংস্থাগুলোর প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নয়নে সাহায্য করে। এ ধরনের আন্দোলনের মাধ্যমে বিতর্কিত আইন, প্রশাসনে প্রাক্তন ক্রীড়াবিদদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও পৃ্ষ্ঠপোষকতার সঙ্গে জড়িত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করে।
ক্রীড়া সাংবাদিক শারদা উগরা বলেন, ভারতের ক্রীড়া জগতে এ ধরনের আন্দোলন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর আগে কোনো ক্রীড়া সংস্থার ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড়দের এভাবে প্রকাশ্যে আন্দোলন করতে দেখা যায়নি।
জানা যায়, ভারতের রেসলিং ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ভূষণ সিংয়ের বিরুদ্ধে চারটি বিচারাধীন ফৌজদারি মামলা রয়েছে। এরপরও তিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে ভারতীয় কুস্তির নেতৃত্বে ছিলেন।
২০২১ সালে তিনি খেলার মঞ্চে এক কুস্তিগীরকে চড় মেরে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। পরে দাবি করেছিলেন, ওই কুস্তিগীর কোনো একটি টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার জন্য বয়স জালিয়াতি করেছেন। অথচ ভূষণ সিং ওই খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ দেননি।
সাম্প্রতিক বিক্ষোভগুলো দেশটির ক্রীড়া জগতে যৌন নির্যাতনের ব্যাপকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। প্রাক্তন টেনিস খেলোয়াড় মনীষা মালহোত্রা বলেন, ক্রীড়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সবেমাত্র শুরু হয়েছে। কর্তাব্যক্তিদের এমন আচরণ একজন খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার নষ্ট করে দিতে যথেষ্ট।
‘আমি ও অন্য খেলোয়াড়রা এসে কোচদের দুর্ব্যবহারের বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের অভিযোগ গ্রহণ করেনি। ভারতীয় ক্রীড়াক্ষেত্রে এখন শক্তিশালী মি টু আন্দোলন দরকার। ঠিক যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জিমন্যাস্টরা ল্যারি নাসারের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছিলেন সেরকম কিছু প্রয়োজন৷'
যুক্তরাষ্ট্রের জিমন্যাস্টিকস দলের সাবেক চিকিৎসক ল্যারি নাসারের বিরুদ্ধে ২৬৫ নারী অ্যাথলিটকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ওঠে। ২০১৮ সালে বিষটি নিয়ে মামলা হলে প্রায় ১৬০ জন নারী জিমন্যাস্ট তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৫৪ বছর বয়সী ল্যারিকে ১৭৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
তবে বিবিসি বলছে, এদিক থেকে ভারতীয় খেলোয়াড় বা ক্রীড়াবিদরা চাপের মধ্যে থাকেন। কারণ ভারতের কোনো ক্রীড়া কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর পর, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রবণতা ও রেকর্ড খুব কম।
সরকারি একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়ার (এসএআই) কোচ ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ৪৫টি যৌন হয়রানির অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। তাদের মধ্য থেকে পাঁচ কোচের বেতন কাটা হয়, দুজনের সঙ্গে চুক্তি বাতিল ও একজনকে স্থগিত করেও পরে আবার বহাল রাখা হয়। বাকি অভিযোগগুলো খারিজ করা দেওয়া হয়।
তবে অনেকের দাবি, সম্প্রতি কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ছে। যেমন, গত বছর সাত ক্রীড়াবিদ একত্রিত হয়ে বিখ্যাত এক ট্র্যাক (দৌড়) কোচের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন। সেময় তাকে গ্রেফতার করা হয় ও এ সংক্রান্ত একটি মামলা চলমান রয়েছে।
তাছাড়া চলতি বছর একজন নারী সাইক্লিস্টের অভিযোগ তদন্ত করে, প্রধান সাইক্লিং কোচকে বরখাস্ত করে স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া। ওই কোচের বিরুদ্ধে নারী খেলোয়াড়ের সঙ্গে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা ও বিদেশে ক্যাম্প চলাকালে একই ঘরে থাকতে বাধ্য করার অভিযোগ ওঠে।
মনীষা মালহোত্রা বলেন, ভারতীয় খেলোয়াড়দের সমর্থন দিতে আরও বেশি কিছু করা দরকার। কিন্তু যারা বিভিন্ন ফেডারেশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা নিজ নিজ জায়গা থেকে অনেক শক্তিশালী। তাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান খেলোয়াড়দের কাছে সত্য বলাটা কঠিন করে তোলে।
বিবিসি বলছে, ভারতের বেশিরভাগ ক্রীড়া ফেডারেশনে যৌন হয়রানির অভিযোগ মোকাবিলার জন্য মনিটরিং বা তদারকি কমিটি নেই। সরকারিভাবে স্বীকৃত ৫৬টির মধ্যে ১০টিরও কম ক্রীড়া ফেডারেশনে এ ধরনের কমিটি রয়েছে।
স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়ার সাবেক প্রধান জিজি থমসন বলেন, আমি ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সংস্থাটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। সেসময় যৌন হয়রানির অসংখ্য অনানুষ্ঠানিক অভিযোগ পেয়েছি। কিন্তু খেলোয়াড়েরা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করতে চাইতেন না। যখনই আমরা তদন্ত করতে যেতাম, তখনই তারা পিছিয়ে যেতেন।
সুইজারল্যান্ডের অলাভজনক সংস্থা গ্লোবাল অবজারভেটরি ফর জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যান্ড স্পোর্টের সিইও পায়োশনি মিত্র বলেন, স্পোর্টস হোস্টেল সিস্টেমটি অল্পবয়সী মেয়েদের জন্য কঠিন একটি জায়গা। আবার বাড়িতে থাকলেও পরিবার তাদের বিয়ে দিতে পারে। তাই সার্বিকভাবেই ভারতের মেয়েরা অর্থাৎ নারী খেলোয়াড়েরা বহুমুখী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী খেলোয়াড় বলেন, আমি স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়ার একটি হোস্টেলে এক দশকেরও বেশি সময় কাটিয়েছি। যখন সেখানে যাই, তখন আমার বয়স ১০ বছর। জাতীয় শিবিরে প্রবেশের সময় আমাকে প্রথম যে জিনিসটি শেখানো হয়েছিল তা হলো, কোচ ও কর্মকর্তারা যা বলবেন, তা অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে।
‘ফলে আমি ছোটবেলা থেকেই তাদের ভয় করতে শিখেছি। আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি যে, যৌন হয়রানি, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন যখন হয়, তখন নারীদের মানসিক অবস্থা কেমন হয়। আপনি এসব অনিয়ম বন্ধ করতে চাইলে সবাই আপনাকে বলবে, থেমে যাও। যে পেশায় রয়েছো, সেখান থেকে লড়াইয়ে নামলে সবকিছু হারাতে হবে। এমন কথা শোনার পর আর কে ঝুঁকি নিতে চান, বলুন?’
সূত্র: বিবিসি
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন