ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া কি সত্যিই সম্ভব?
তুরস্ক-সিরিয়ায় এ শতাব্দীর ভয়াবহতম ভূমিকম্প আঘাত হানার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি বিষয় নিয়ে বেশ তোলপাড় চলছে- দক্ষিণ এশিয়ায় নাকি খুব শিগগির আঘাত হানতে পারে বড় ভূমিকম্প। এমনকি ভাইরাল কিছু কিছু পোস্টে সরাসরি দিনক্ষণ উল্লেখ করে বাংলাদেশে ভূমিকম্প আঘাত হানার কথিত পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে।
তবে সত্যিই কি এ ধরনের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব? বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় কি সত্যিই অদূর ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্প আঘাত হানতে চলেছে? এখানে প্রথম প্রশ্নের উত্তর ‘না’ এবং দ্বিতীয়টির উত্তর ‘আমরা জানি না’।
এসব গুজব ছড়িয়েছে মূলত নিজেদের ‘সোলার সিস্টেম জিওমেট্রি সার্ভে’ বা এসএসজিইওএস নামে পরিচয় দেওয়া একটি সংগঠন। চাঁদের গতিবিধি, অবস্থান, পৃথিবীর জ্যামিতিক বিষয় এবং বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তুর ভিত্তিতে দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশে ভূমিকম্পের সম্ভাব্য দিনক্ষণ ও মাত্রা অনুমানের দাবি করেছে সংগঠনটি।
গত ৩০ জানুয়ারি পৃথিবীর মানচিত্রের ওপর দুটি বেগুনি রঙের দাগ টানা ছবি দিয়ে টুইটারের এক পোস্টে এসএসজিইওএস দাবি করে, চিহ্নিত এলাকাগুলোতে আগামী এক থেকে ছয় দিনের মধ্যে বা কাছাকাছি সময়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প হতে পারে। তবে অন্য অঞ্চলগুলোকেও বাদ দেওয়া হচ্ছে না।
এসএসজিইওএসের কথিত এই পূর্বাভাসের পরে টুইটারে একই অ্যাকাউন্ট থেকে কথিত ডাচ ‘ভূকম্পনবিদ’ ফ্রাঙ্ক হুগারবিটসের একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়। ওই ভিডিওতে অদূর ভবিষ্যতে ভূমিকম্প আঘাত হানার সম্ভাব্য জায়গাগুলো দেখানো হচ্ছিল। এসব জায়গার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াও ছিল।
তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প আঘাত হানার তিন দিন আগেই তা সঠিকভাবে অনুমান করার দাবিতে হুগারবিটস কয়েকদিন ধরে বেশ আলোচতি-সমালোচিত হচ্ছেন। তবে তার এ ধরনের পূর্বাভাস এসএসজিইওএসের মতো সংগঠনগুলোর কার্যকলাপকে পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক উল্লেখ করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা জানিয়েছেন, আধুনিক বিজ্ঞানে এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পের সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস দেওয়ার মতো কোনো উপায় আবিষ্কৃত হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) তার ওয়েবসাইটে বলেছে, ইউএসজিএস বা অন্য কোনো বিজ্ঞানী কখনোই কোনো বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেননি। আমরা জানি না এটি কীভাবে দেয় এবং অদূর ভবিষ্যতে জানা যাবে বলেও আশা করি না।
ইউএসজিএসের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, তারা কেবল একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ‘নির্দিষ্ট সংখ্যক বছরের মধ্যে’ উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাব্যতা গণনা করতে পারেন।
বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান ও প্রকৌশল ইনস্টিটিউট ক্যালটেকও বলছে, কবে কখন কোথায় ভূমিকম্প হবে বা কত বড় হবে তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।
তাহলে হুগারবিটস কীভাবে তিন দিন আগে ঠিকঠাক পূর্বাভাস দিলেন? এটিকে অনেকটা ঝড়ে বক মরার মতো বিষয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
হুগারবিটসের একটি ভিডিওর প্রতিক্রিয়ায় ওরেগন ইউনিভার্সিটির জিওফিজিক্সের সহযোগী অধ্যাপক দিয়েগো মেলগার টুইটারে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে আমরা এটিকে ‘স্নেক অয়েল’ (সাপের তেল) বলি। এটিকে ‘হাতুড়ে’ হিসেবেও উল্লেখ করা যেতে পারে।
লেবানিজ সংবাদমাধ্যম ল’ওরিয়েন্ট টুডের সাংবাদিক রিচার্ড সালামে এক টুইটে বলেছেন, এই অ্যাকাউন্টটি (ফ্রাঙ্ক হুগারবিটস) দ্রুত ১০ লাখ অনুসারীর দিকে যাচ্ছে, যার বেশিরভাগই আমাদের অঞ্চল থেকে। বিজ্ঞানীরা একমত যে, ভূমিকম্পের পূর্বাভাসের কোনও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নেই। তাই দয়া করে তাকে মানুষের আসল ভীতির সুযোগ নিতে দেবেন না।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, সাম্প্রতিক গবেষণায় চাঁদের অবস্থানের কারণে পৃথিবীতে সৃষ্ট জোয়ার-ভাটা এবং কয়েক ধরনের ভূমিকম্পের মধ্যে সম্পর্ক দেখতে পাওয়া গেছে। তারপরও চাঁদের কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে সঠিকভাবে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া কার্যত অসম্ভব।
মানুষের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি পাওয়া তিনটি প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছে ইউএসজিএস। সংস্থাটি বলেছে, একটি ভূমিকম্পের পূর্বাভাসে অবশ্যই তিন উপাদান থাকবে: ১) তারিখ ও সময় ২) অবস্থান এবং ৩) মাত্রা।
কিছু লোক দাবি করে তারা ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। কিন্তু তাদের দাবি মিথ্যা হওয়ার কিছু কারণ রয়েছে:
১. ভূমিকম্প একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার অংশ। কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণীর দাবিগুলো বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে নয়। উদাহরণস্বরূপ, ভূমিকম্পের সঙ্গে মেঘ, শারীরিক যন্ত্রণা বা শামুকের কোনো সম্পর্ক নেই।
২. সেগুলো পূর্বাভাসের জন্য আবশ্যক তিনটি উপাদানকে সংজ্ঞায়িত করে না।
৩. তাদের ভবিষ্যদ্বাণী এতটাই সাধারণ যে, এর সঙ্গে মিলে যাওয়ার মতো ভূমিকম্প সবসময়ই থাকবে। যেমন- আগামী ৩০ দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও একটি চার মাত্রার ভূমিকম্প হবে অথবা দেশটির পশ্চিম উপকূলে আজ একটি দুই মাত্রার ভূমিকম্প হবে।
সূত্র: ইউএসজিএস, ক্যালটেক, দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন