প্রকাশিত : ৪ মার্চ, ২০২৩ ১৫:৪৬

আরেক হুমকিতে ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট

অনলাইন ডেস্ক
আরেক হুমকিতে ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ব্রাজিলের নতুন বামপন্থি প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। নতুন প্রেসিডেন্ট লুলার শপথ নেওয়ার এক সপ্তাহ পর, তার ডানপন্থি পূর্বসূরী জেইর বলসোনারোর হাজার হাজার সমর্থক প্রেসিডেন্ট ভবন, কংগ্রেস ও সুপ্রিম কোর্টে হামলা চালায়। নির্বাচনের ফলাফল মানতে নারাজ ছিল তারা।

দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট লুলা সুদের হার বাড়ানো নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লড়াই করেছেন। সম্প্রতি জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের সঙ্গে একটি প্রেস কনফারেন্সে, রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন নিয়ে লুলার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এখন প্রেসিডেন্ট লুলা আরেকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। শোনা যাচ্ছে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারো মার্চ মাসে ফ্লোরিডার স্বেচ্ছায় নির্বাসন ত্যাগ করে দেশে ফিরবেন।

প্রথমত যদিও ধরে নেওয়া যায় এ নিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট লুলার উদ্বেগের তেমন কিছু নেই। কেননা বলসোনারোর প্রভাব ম্লান হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত জানুয়ারিতে প্রায় ৭৬ শতাংশ ব্রাজিলিয়ান সরকারি ভবনে হামলার বিরোধিতা করেছিলেন। সাবেক প্রেসিডেন্টের অনেক ঘনিষ্ঠও নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন এখন পর্যন্ত।

আইনি জটিলতায় বলসোনারোর বিদেশে থাকার সময় দীর্ঘায়িত হতে পারে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে মিথ্যা প্রচার করা থেকে শুরু করে বিক্ষোভে উসকানি দেওয়ার মতো নানাবিধ অভিযোগে ব্রাজিলে একডজন তদন্ত হচ্ছে তার বিরুদ্ধে। যার প্রায় সবই তিনি অস্বীকার করেছেন। যদি তিনি ব্রাজিলে ফিরে যান, তবে তাকে এসব অভিযোগ ও মামলা মোকাবিলা করতে হবে। অফিসে ফিরতে বাধাও দেওয়া হতে পারে তাকে।

তবে লক্ষ্য করা যায় বলসোনারো ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। লুলার ওয়ার্কার্স পার্টির শাসনকালে একটি বড় দুর্নীতির কেলেঙ্কারি প্রকাশ পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর সঙ্গে অসন্তোষের জেরে বলসোনারো ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসেন। ডানপন্থি সরকার দেশটির তরুণ, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান, কৃষিখাত ও ব্যবসা, ক্ষুদ্র কৃষক এবং খনি শ্রমিকদের সমর্থন পেয়েছিলেন। এখনো ব্যাপকভাবে সাবেক প্রেসিডেন্টকে সমর্থন করে তারা।

সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, তরুণ ব্রাজিলিয়ানদের কাছে আবেদন ধরে রাখতে পেরেছেন তিনি। সম্প্রতি একটি জরিপে, ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ বলেছেন পরের রোববার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তারা বলসোনারোকে নির্বাচিত করবেন। এই সংখ্যা যে কোনো বয়সের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্য আরেকটি জরিপে দেখা গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ ব্রাজিলিয়ান বলেছেন তারা বিশ্বাস করেন না লুলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। যে দলটি এমন ধারণা পোষণ করে তাদের বয়স ২৫ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে।

বলসোনারোর বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মে ৬৫ মিলিয়ন ফলোয়ার রয়েছে যেখানে লুলার রয়েছে ৩১ মিলিয়ন। ব্রাজিলের রাজনীতিতে সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। গত বছরের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটে জয়ী ডেপুটি ছিলেন নিকোলাস ফেরেরা। তিনি একজন ২৬ বছর বয়সী বলসোনারোর সমর্থক যিনি ভিডিও-স্ট্রিমিং অ্যাপ টিকটক-এ খ্যাতি অর্জন করেন।

সাবেক সেনা অধিনায়ক হওয়ার কারণেও সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের বলসোনারোর প্রতি অনুরাগ রয়েছে। তার অধীনে সেনাবাহিনীর পেনশনের বিষয়গুলো ঝামেলামুক্ত হয়। ফেডারেল সরকারি চাকরিতে বর্তমান ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তার সংখ্যা দ্বিগুণেরও বা ৬ হাজারের বেশি।

রাজধানী ব্রাসিলিয়ার নিরাপত্তাপ্রধান অ্যান্ডারসন টরেস ও বলসোনারোর মিত্র, জানুয়ারির বিক্ষোভের দুই দিন আগে ফ্লোরিডায় উড়াল দেন। পুলিশ পরে তার বাড়িতে একটি খসড়া ডিক্রি খুঁজে পেয়েছিল, যা বিচারমন্ত্রী হিসাবে তার সময়কালের। বিদ্রোহের সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিল ঘটনাস্থলে। দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায়, লুলা সরকার কয়েক ডজন সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তাসহ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানকে বরখাস্ত করেন।

রিও ডি জেনিরোর ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রদ্রিগো নুনেস বলেছেন বলসোনারো ‘রাজধানীর বনাঞ্চলের পশ্চিম’ এর সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে গবাদি পশু পালনকারীরা যারা অবৈধভাবে কাঠ কাটার মাধ্যমে তাদের এলাকা প্রসারিত করেছে। একইভাবে বেআইনি স্বর্ণ-খনি শ্রমিকরা বলসোনারোর অধীনে আমাজনে বড় ধরনের ক্ষতি করেছে। যেখানে লুলা তাদের লাগাম টেনে ধরার প্রচেষ্টা করছেন।

কৃষিখাতও ব্রাজিলের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কৃষি সংক্রান্ত ব্যবসা নিয়ে কংগ্রেসের প্রায় অর্ধেকের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ২০১০ সাল থেকে। ২০০৩ ও ২০১০ এর মধ্যে তার প্রথম দুটি প্রশাসনের অধীনে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় হওয়া সত্ত্বেও, এই সেক্টরের অনেকেই লুলা সম্পর্কে সতর্ক রয়েছেন।

ব্রাজিল এখন বিশ্বের বৃহত্তম সয়াবিন রপ্তানিকারক, যার ৭০ শতাংশ চীনে চলে যায়। বলসোনারোর অধীনে, চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক কিছুটা স্তিমিত হয়। তবে কিছু কৃষি ব্যবসা সাবেক প্রেসিডেন্টের সময় উন্নতি লাভ করে। কৃষকদের জন্য ভর্তুকিযুক্ত সরকারি ঋণ প্রসারিত করা হয়েছিল।জানুয়ারি মাসে বিদ্রোহীদের লরি, ট্রাক্টর ও খাবার সরবরাহ করতে কৃষি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত লোকেরা সাহায্য করেছিল কি না তা তদন্তকারীরা খতিয়ে দেখছেন।

বলসোনারোর প্রতি সমর্থনে লুলার প্রতিক্রিয়া আংশিকভাবে নির্ধারণ করবে এটি একটি শক্তিশালী পক্ষ থাকবে কি না। এখন পর্যন্ত, তার বক্তব্য এবং নীতি তার বিরুদ্ধে কাজ করছে। প্রেসিডেন্ট গত জানুয়ারিতে বিক্ষোভকারীদের ‘নাৎসি’ বলে অভিহিত করেন। অফিসে তার প্রথম সপ্তাহে তিনি দুটি বিভাগ তৈরি করেন যা বিরোধী রাজনীতিবিদ ও মুক্ত চর্চার সমর্থক উভয়কেই চিন্তিত করে।

লুলার সরকারি আদেশ বাকস্বাধীনতার প্রভাব সম্পর্কে শঙ্কা জাগিয়েছে। এ ছাড়া অনলাইনে ভুয়া খবর নিয়ন্ত্রণের জন্য সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে চুক্তি করার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক আলেকজান্দ্রে ডি মোরেস গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে মনে করেন এমন কয়েক ডজন অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ করেন। বলসোনারোর সমর্থকরা একে সেন্সরশিপ বলেন নিন্দা করছেন।

অর্থনীতিও আপাতত লুলার অনুকূলে নেই। কোভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ২০২১ সালে ব্রাজিলকে একটি উৎসাহ জুগিয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাচ্ছে লুলা সরকার। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী ফার্নান্দো হাদ্দাদ বলেন তিনি জ্বালানি কর পুনরায় আরোপ করবেন। যা বলসোনারো গত বছরের নির্বাচনের আগে তুলে নিয়েছিলেন। ওয়ার্কার্স পার্টির প্রধান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে দাম বাড়ানোর জন্য হাদ্দাদকে সমালোচনা করেন। তার দলের মধ্যে এ ধরনের দ্বন্দ্ব লুলার পক্ষে শাসন কাজ কঠিন করে তুলতে পারে।

লুলা মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ পয়েন্ট ব্যবধানে নির্বাচনে জয়ী হন। ১৯৮৫ সালে ব্রাজিলের গণতন্ত্রে ফিরে আসার পর থেকে সবচেয়ে কঠিন ফলাফল ছিল এটি। বলসোনারোর লিবারেল পার্টি ২০১৮ সালের তুলনায় গত বছর ৬৬টি বেশি আসন জিতেছে এবং এটি নিম্নকক্ষে সবচেয়ে বড় সংখ্যা। বলসোনারোর সঙ্গে জোটবদ্ধ প্রার্থীরাও সিনেট দখলের জন্য ২৭টি আসনের মধ্যে ১৩টি জিতেছেন। সামগ্রিকভাবে, বলসোনারোর মিত্ররা এখন দুটি চেম্বারের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করে। দেশের তিনটি সর্বাধিক জনবহুল এবং ধনী রাজ্য বলসোনারোর সঙ্গে সম্পৃক্ত গভর্নররা পরিচালনা করেন।

প্রেসিডেন্ট লুলার প্রত্যাশা হতে পারে, বলসোনারোর আইনি সমস্যায় পড়া। কিন্তু এমনটা ঘটলেও সাবেক প্রেসিডেন্টের জায়গায় দক্ষিণপন্থি প্রার্থীরা ইতি মধ্যেই চক্কর দিচ্ছেন। বলসোনারোর এক কংগ্রেস সমর্থক লুইজ ফিলিপ দে অরলেন্স ই ব্রাগানসা বলেছেন ‘বলসোনারো অত্যন্ত জনপ্রিয়, কিন্তু এটি আর ব্যক্তিত্বের বিষয় নয়।’ যদি বামপন্থি সরকার তোতলাতে শুরু করে তবে জনগণ ‘সমাধানের জন্য আমাদের দিকে তাকাবে’ বলে তিনি মনে করেন। এটি প্রেসিডেন্ট লুলা যা চাইবে তার চেয়ে অনেক দ্রুত ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন

উপরে