শাস্তি-জরিমানা কমাতে পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের ছক!
নতুন আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় অপরাধের শাস্তি, জরিমানা কমানোসহ সাত দফা দাবিতে আন্দোলনে নামার ছক কষছে পরিবহন শ্রমিকরা। দাবিগুলো মেনে নিতে সরকারকে ২০ থেকে ২৫ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হবে। এই সময়ের মধ্যে দাবি না মানলে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গাড়ি বন্ধ রাখা, এক মিনিট হর্ন বাজানোসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে শ্রমিকরা। আন্দোলনের এই ছক তৈরি করছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। সংগঠনের ২৩৩টি শ্রমিক ইউনিয়ন এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও জানা গেছে।
শ্রমিকদের এই আন্দোলনে সমর্থন রয়েছে বিভিন্ন পরিবহন মালিক সমিতির। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে আদালতের নির্দেশের পর তারা চিন্তায় পড়েছে। বিপুল পরিমাণ জরিমানা গুনতে হচ্ছে বলে এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী গতকাল শুক্রবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী মঙ্গলবার আমরা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে আমাদের দাবিগুলো তুলে ধরব। তিন মন্ত্রীর সমন্বয়ে গঠিত কমিটির কাছে দাবিগুলো পাঠাবেন তিনি। এরপর আমরা সরকারকে ২০-২৫ দিন সময় দেব। দাবি না মানলে অন্য কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাব আমরা।’
ফেডারেশন সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিকদের প্রধান দাবি সড়ক দুর্ঘটনায় অপরাধের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ফাঁসি এবং জরিমানা পাঁচ লাখ টাকা করার বিধান বাতিল করতে হবে। ১৯৮৩ সালের মোটরযান আইনে বেপরোয়া বা অবহেলা করে গাড়ি চালানোর ফলে দুর্ঘটনায় কেউ গুরুতর আহত বা কারো প্রাণহানি হলে চালকের সর্বোচ্চ সাজা ছিল তিন বছরের কারাদণ্ড। নতুন আইনে তা বাড়িয়ে পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আগের আইনে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা থাকলেও নতুন আইনে করা হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। নতুন আইনে বলা হয়েছে, তদন্তে যদি দেখা যায়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চালক বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাহলে সর্বোচ্চ সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড।
শ্রমিকদের দ্বিতীয় দাবি, সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় আসামিকে জামিন দিতে হবে। নতুন আইনে জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। অন্য দাবির মধ্যে আছে অতিরিক্ত ওজনের মালপত্র পরিবহনের জন্য শাস্তি তিন বছরের জেল এবং তিন লাখ টাকার জরিমানা পরিবহন শ্রমিকের কাছ থেকে আদায় না করা। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর বিষয়ে শুধু সার্জেন্টদের ধারণার ওপর মামলা না করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে অতিগতি শনাক্ত হলে মামলা করা। সড়ক-মহাসড়কের পাশে হাট-বাজার উচ্ছেদ এবং ভাঙা রাস্তাঘাট সংস্কার করতে হবে। সড়কের কারণে দুর্ঘটনা হলে দায়ীদের দায় নিরূপণ করতে হবে। এ ছাড়া মহাসড়কের ২২২টি ব্ল্যাক স্পটে দুর্ঘটনার প্রবণতা কমাতে ব্যবস্থা গ্রহণ। ঢাকার বাণিজ্যিক ভবনগুলোর বেশির ভাগ গাড়ি রাখার জায়গায় দোকানপাট ও অন্য বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ভবনের গাড়ি রাখায় জায়গা উদ্ধার করতে রাজউক ও পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সবশেষ দাবি হলো, বেসরকারি গাড়ি চালাতে লাইসেন্স ও ফিটনেস থাকতে হবে।
এসব দাবি আদায়ে পরিবহন শ্রমিকরা সংগঠিত হচ্ছে। তার আগে গত এক মাস ধরে শীর্ষ পরিবহন নেতারা গোপনে বৈঠক করছেন।
গ্রীন লাইন পরিবহনের বাসের চাপায় পা হারানো প্রাইভেট কার চালক রাসেল সরকারকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। গত ৩ এপ্রিল ছিল সেই অর্থ দেওয়ার একটি তারিখ। গ্রীন লাইন পরিবহন কর্তৃপক্ষ এ ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি থাকলেও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের এক শীর্ষ নেতার পরামর্শে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পথ থেকে সরে আসে তারা। পরে অবশ্য গ্রীন লাইন পরিবহন কর্তৃপক্ষ কিছু অর্থ দিতে বাধ্য হয়েছে। রাসেল কৃত্রিম পা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পা হারানো রাসেলকে ক্ষতিপূরণ না দিতে চলতি মাসের শুরুর দিকে দেশের পরিবহন খাতের শীর্ষ নেতারা বৈঠক করেছিলেন। তাঁরা একজোট হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জরিমানা না দিয়ে বিষয়টির সুরাহা করার।
এদিকে গত বুধবার পরিবহন খাতের শীর্ষ নেতারা রাজধানীর ধানমণ্ডিতে এক বাসায় বৈঠক করেছেন। বৈঠকে পরিবহন শ্রমিক নেতা ওসমান আলীও ছিলেন। ওসমান আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এ ধরনের বৈঠক দুই মাস পর পর করি।’ বৈঠকে উপস্থিত অন্য এক পরিবহন নেতা জানান, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-আহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে উচ্চ আদালতের রায়ের বিষয়ও তাঁদের আলোচনায় এসেছে।
ঢাকায় পরিবহন মালিকরা জরিমানা ও শাস্তির প্রতিবাদে কৌশলে কিছু বাস বন্ধ রেখে বিপর্যয় তৈরি করে সাধারণ যাত্রীদের জিম্মি করে রেখেছে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে নতুন আইনটি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ নির্ধারণ ও বাস্তবসম্মত সমাধানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বে তিন মন্ত্রীর সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়। বিধিমালা প্রণয়নে কমিটি গত বৃহস্পতিবার বৈঠক করেছে। কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, আইনের যেসব ধারা নিয়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের আপত্তি রয়েছে, সেগুলো নিয়ে তাঁরা অংশীজনদের সঙ্গে শিগগিরই বৈঠক করবেন।
সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া ২০১৭ সালের ২৭ মার্চ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করার পর থেকেই ধাফে ধাপে আন্দোলনে গেছে পরিবহন শ্রমিকরা। আইনটি গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে অনুমোদন হয়। আইনের বিভিন্ন ধারা বাতিলের দাবিতে গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে দেশজুড়ে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট পালন করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন।