প্রকাশিত : ৪ মার্চ, ২০২১ ১৩:৪০

এইচ টি ইমাম : এক কর্মবীরের প্রস্থান

অনলাইন ডেস্ক
এইচ টি ইমাম : এক কর্মবীরের প্রস্থান

হোসেন তৌফিক ইমাম। যিনি এইচ টি ইমাম নামেই পরিচিত। একজন ডাকসাইটে আমলা, বীর মুক্তিযোদ্ধা। সরকারি চাকরি শেষ করে দীর্ঘ কর্মময় জীবনেও হয়ে উঠেছিলেন একজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। পাশাপাশি ছিলেন সুবক্তা ও লেখক।

বুধবার (৩ মার্চ) দিবাগত রাত ১টার পর রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) এই কর্মবীরের জীবনাবসান হয়েছে। তার বিয়োগে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে এইচ টি ইমামের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে আজীবন কাজ করে গেছেন। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সদ্য স্বাধীন দেশে সরকার পরিচালনায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনায়ও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার মৃত্যুতে আওয়ামী লীগ একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতাকে হারাল।’

সহযোদ্ধা ও উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। সবার শোকেই উঠে এসেছে, তার কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবনের ভূয়সী প্রশংসা।

জানা গেছে, এইচ টি ইমাম পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা হয়েও ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদায় জনপ্রশাসন-বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। ২০১৪ সালে তাকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে তার কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে।

প্রাথমিক ও শিক্ষাজীবন

১৯৩৯ সালের ১৫ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতা তাফসির উদ্দীন আহমেদ বিএ, বিএল ও মাতা তাহসিন খাতুন। পিতার চাকরি সূত্রে শৈশবে তিনি রাজশাহীতে বড় হন। সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। পরে লেখাপড়া করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া ও কলকাতায়। ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেছেন ঢাকা কলেজিয়েট হাইস্কুল থেকে। ১৯৫৪ তে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে। ১৯৫৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তি হন। সেখানে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৫৮ সালে ঢাবি থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স থেকে ‘উন্নয়ন প্রশাসনে’ পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা করেন।

কর্মজীবন

এইচ টি ইমাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করার পর তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ১৯৬২ সালে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসেবে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন। শুরুতে তিনি রাজশাহী কালেক্টরেটে ১৯৬২-১৯৬৩ মেয়াদে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এরপর পদোন্নতি পেয়ে ১৯৬৩-১৯৬৪ মেয়াদে নওগাঁ মহকুমায় মহকুমা প্রশাসক বা এসডিও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে নারায়ণগঞ্জ মহকুমার এসডিও হিসেবে বদলি হন এবং প্রায় এক বছর তিনি সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম ক্যাবিনেট সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের ক্যাবিনেট সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭৫-এর ২৬ আগস্ট পর্যন্ত তিনি ক্যাবিনেট সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত সাভারের লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত তিনি সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত পরিকল্পনা সচিব ছিলেন। তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও যমুনা মাল্টিপারপাজ ব্রিজ অথরিটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১’র মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা

১৯৭১-এর মার্চ মাসে তিনি রাঙ্গামাটি জেলার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বে ছিলেন। আমলা হয়েও পাকিস্তানের আনুগত্য ত্যাগ করে প্রবাসী সরকারের অধীনে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।

রাজনৈতিক জীবন

এইচ টি ইমাম আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। ২০০৯ থেকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৯ সালে জনপ্রশাসন-বিষয়ক উপদেষ্টা এবং ২০১৪ সাল থেকে আমৃত্যু প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এবং প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন।

প্রকাশনা

তার গ্রন্থ বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫ : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ অবধি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের বিশদ বিবরণ স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- বাকশাল গঠন সম্পর্কিত তথ্যাবলী। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাসহ নানা বিষয়ে তার বই ও আর্টিকেল প্রকাশ হয়েছে।

মৃত্যু

কিডনি জটিলতায় প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার (৩ মার্চ) দিবাগত রাত ১টা ১৫ মিনিটে মারা যান এই কর্মবীর। সকালে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া ও বিকেলে গুলশানে জানাজা শেষে বনানী গোরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

দৈনিক চাঁদনী বাজার  / সাজ্জাদ হোসাইন

উপরে