প্রকাশিত : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১১:৪৭

কুরিয়ার সার্ভিসে ড্রাগ ডিটেক্টর স্থাপনের চিন্তা

অনলাইন ডেস্ক
কুরিয়ার সার্ভিসে ড্রাগ ডিটেক্টর স্থাপনের চিন্তা

মাদক পরিবহণের নিরাপদ মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিস। নতুন মাদক এলএসডি থেকে শুরু করে জীবন ধ্বংসকারী এ ধরনের দ্রব্য এই সার্ভিসের মাধ্যমে অবাধে ঢুকছে দেশে। আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারী চক্রের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে দেশ থেকেও মাদক পাচার হচ্ছে। এক বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন অন্তত ৩২টি চালান জব্দ করেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও দক্ষ জনবলের অভাবে অনেক সময় কুরিয়ারে আসা মাদকের চালান সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে বা বের হচ্ছে খুব সহজেই। এ অবস্থা রোধে পণ্য পরিবহণের প্রধান ‘হাবগুলোতে’ অত্যাধুনিক ‘ড্রাগ ডিটেক্টর মেশিন’ স্থাপনের চিন্তা চলছে। শুরু হয়েছে ‘ডগ স্কোয়াড’ মোতায়েন ও ‘সাইবার ক্রাইম সেল গঠন’ প্রক্রিয়া। বিমানবন্দর, স্থল ও নৌবন্দরে পার্সেল সার্ভিসের মনিটরিং কার্যক্রম জোরদারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি পরিবহণ হচ্ছে দামি ও সহজে বহনযোগ্য মাদকদ্রব্য এবং ক্ষেত্রভেদে এর কাঁচামাল। এর মধ্যে রয়েছে-এলএসডি, আইস বা ক্রিস্টাল মেথ, ইয়াবা, খাট, হেরোইন, ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল অ্যামফিটামিন। দ্রব্যগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মাদক সিন্ডিকেটের যোগসাজশে দেশে ঢুকছে অথবা বাংলাদেশকে রুট হিসাবে ব্যবহার করে পাচার করা হচ্ছে। এছাড়া দেশে এ পর্যন্ত উদ্ধার ২৫ ধরনের মাদকের বেশির ভাগই এখন কুরিয়ার বা পার্সেল সার্ভিসে পরিবহণ হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে পরিবহণ হওয়া মাদকের তালিকায় কোকেন, আফিম, গাঁজা, ফেনসিডিল ও ইনজেকটিং ড্রাগের নামও রয়েছে। ঝুঁকি এড়াতে অধিকাংশ সময় অননুমোদিত কুরিয়ার সার্ভিস বেছে নিচ্ছে মাদক গডফাদাররা। করোনায় মানুষের যাতায়াত সীমিত থাকায় এবং মাদকের চাহিদা বাড়ায় কুরিয়ারের মাধ্যমে এই অপকর্ম আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আব্দুস সবুর মণ্ডল বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক সরবরাহের বিষয়টি আমরা খুবই গুরুত্ব সহকারে নিয়েছি। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মিটিংও হয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গেও ভার্চুয়াল মিটিং করেছি। আমরা যে কোনোভাবে এটি বন্ধ করতে চাই। সেজন্য ড্রাগ ডিটেক্টরের মাধ্যমে কুরিয়ারের পণ্য স্ক্যানিং নিশ্চিতে কাজ চলছে। অননুমোদিত কুরিয়ার সার্ভিস বন্ধের বিষয়টিও ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। কারণ তারাই কুরিয়ারের লাইসেন্স দেওয়ার অথরিটি। কয়েকদিন আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায়ও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কুরিয়ারের মাধ্যমে মাদক পরিবহণ বন্ধে প্রয়োজন দক্ষ জনবল। সেজন্য ডাক বিভাগের কিছু কর্মকর্তা ও কুরিয়ার সার্ভিসের কিছু কর্মকর্তাকে আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সোমবার থেকে এ প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নগদ টাকার প্রলোভনে মাদক কারবারিদের পাশাপাশি কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশও এই কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এ বছর ১১ আগস্ট অভিনব কায়দায় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ইয়াবা পাঠানোর সময় দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে ১০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। জব্দ করা হয় ইয়াবা বহনে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেলটির সিট কভারের নিচে এয়ার ফিল্টারে রাখা হয় ইয়াবা। চলতি বছরের মে মাসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এলএসডি সরবরাহকারী একটি চক্রকে গ্রেফতার করে। তারাও নতুন এই মাদক পরিবহণে কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করত। এর আগে গত বছর ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ থেকে ১২ কেজি অ্যামফিটামিন উদ্ধার করা হয়, যা অস্ট্রেলিয়া পাচার হচ্ছিল। গত বছরের ১০ আগস্ট আরেকটি কুরিয়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউস থেকে সাড়ে তিন হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। ছয়টি ট্রাভেল ব্যাগভর্তি এই চালান সৌদি আরবে পাঠানো হচ্ছিল। এ ঘটনায় গ্রেফতার হন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাও। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে মাদক পাচার চেষ্টার এমন অসংখ্য ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়েছে। ৭১টির বেশি কুরিয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

২২ আগস্ট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কুরিয়ারে মাদক পরিবহণের বিষয়টি নিয়ে একটি পরিবীক্ষণ সভার আয়োজন করে। সেখানে বিস্তারিত আলোচনা শেষে নয়টি সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে-পার্সেল বুকিং নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেরকের পূর্ণাঙ্গ নাম, ঠিকানা, ছবি, বৈধ মোবাইল নাম্বার ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি সংরক্ষণ করতে হবে। প্রেরক অনুপস্থিত থাকলে তার প্রতিনিধির তথ্য নিতে হবে। ডাক ও কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিটি ডাক ও পার্সেল গ্রহণের ক্ষেত্রে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনয়নের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও সমুদ্রবন্দরে মাদক পাচার রোধে একটি সেন্ট্রাল মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। ডিএনসি নেতৃত্বাধীন এ সেলের মাধ্যমে পোস্টাল সার্ভিস, পার্সেল সার্ভিস ও কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যক্রম মনিটরিং জোরদার করতে হবে।

সিদ্ধান্তের মধ্যে আরও রয়েছে-লাইসেন্সবিহীনভাবে পরিচালিত কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা। অবৈধ মাদক শনাক্তকরণে ডাক অধিদপ্তর ও কুরিয়ার সার্ভিস কর্তৃক আধুনিক স্ক্যানার সংগ্রহে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে ভ্যাট ও ট্যাক্স মওকুফের আবেদন করা। অবৈধ মাদক পাচার রোধে বাংলাদেশ ডাক অধিদপ্তর ও কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। পার্সেল বুকিং নেওয়ার সময় পাউডার, ক্রিস্টাল, ট্যাবলেট আকারে কোনো মাদকদ্রব্য অনুমিত বা সন্দেহ হলে তা সরাসরি পার্সেল খুলে পরিবীক্ষণ করা। সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের পাশাপাশি ড্রাগ ডিটেক্টর মেশিন স্থাপন।

কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি হাফিজুর রহমান পুলক বলেন, মাদক শনাক্তকরণে ড্রাগ ডিটেক্টর এবং স্ক্যানার স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। মেশিন ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ প্রয়োজন। তাহলে এই প্রক্রিয়া সহজ হবে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে প্রায় ৭১টির বেশি কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করছে, যারা লাইসেন্স ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া যারা বৈধভাবে কুরিয়ার সার্ভিস পরিচালনা করছে তাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মাদক শনাক্তকরণে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।

দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন

উপরে