প্রকাশিত : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১০:৫০

জাল কাগজে ৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ

অনলাইন ডেস্ক
জাল কাগজে ৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ

জাল রপ্তানি বিল বানিয়ে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা নগদ সহায়তা আত্মসাৎ করেছে এমটি এগ্রো ফুড প্রোডাক্ট নামের একটি কোম্পানি। ব্যাংক ও অডিট ফার্মের যোগসাজশে এ অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিটে বেরিয়ে আসে এসব তথ্য। জালিয়াতি ধরা পড়ায় প্রতিষ্ঠানটির লিয়েন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ইতোমধ্যে টাকা কেটে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নিয়মিত কাজের অংশ হিসাবেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নগদ সহায়তা কার্যক্রম অডিট করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যাংকগুলো রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তা দিচ্ছে কি না, সেটা দেখভাল করাই এর মূল উদ্দেশ্য।

এমটি এগ্রোর লিয়েন ব্যাংক অডিটের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক দেখে রেমিট্যান্স হাউজের মাধ্যমে পাঠানো অর্থকে রপ্তানি হিসাবে দেখিয়ে প্রণোদনা নেওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) অধিকতর অনুসন্ধানে জন্য শুল্ক গোয়েন্দাকে দায়িত্ব দেয়।

শুল্ক গোয়েন্দায় পাঠানো বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমটি এগ্রো মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে দুটি প্রতিষ্ঠানে মসলা রপ্তানি করে। এতে হলুদ, মরিচ, আদা, ধনিয়ার গুঁড়া রপ্তানির কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু এগুলো আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। একটি প্রতিষ্ঠান গুঁড়া দুধ এবং অন্যটি বেকারি আইটেমের ব্যবসা করে।

প্রকৃতপক্ষে এমটি এগ্রো রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসন না করে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে পণ্যমূল্য বিদেশে পাচার করছে। পরে রেমিট্যান্স হাউজের মাধ্যমে সেই অর্থ প্রত্যাবাসন দেখিয়ে নগদ সহায়তা পকেটে ভরেছে। এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুল্ক গোয়েন্দা অনুসন্ধানে নামলে বেরিয়ে আসে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।

তদন্তের শুরুতে শুল্ক গোয়েন্দা ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানটির জমা দেওয়া রপ্তানি বিলের (বিল অব এক্সপোর্ট) ২৬টি কপি সংগ্রহ করে। এর ভিত্তিতে চট্টগ্রামের যেসব অফডক (বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) ও শিপিং এজেন্টের মাধ্যমে রপ্তানি করা হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে, সেগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়।

অফডক থেকে জানানো হয়, বিল অব এক্সপোর্টের নম্বরগুলোর বিপরীতে কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি। আর যে শিপিং এজেন্টের নাম ব্যবহার করা হয়েছে তার অস্তিত্ব নেই। শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে জানানো হয়, রপ্তানি বিলে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান তাদের সদস্য নয় এবং প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা নেই। অর্থাৎ রপ্তানিকারক নগদ সহায়তা আত্মসাৎ করতে জাল বিল অব এক্সপোর্ট বানিয়েছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে শুল্ক গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও প্রতিষ্ঠানের মালিকদের শুনানির জন্য তলব করে। শুনানিতে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, গ্রাহকের আবেদনের ভিত্তিতে ভর্তুকি সংক্রান্ত সব দলিলাদি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত অডিট ফার্মে পাঠানো হয়। শফিক বসাক অ্যান্ড কোং এবং আতা খান অ্যান্ড কোং নামের অডিট ফার্ম দুটি দলিলাদি পর্যবেক্ষণ করে।

এতে দেখা যায়, আবেদন ভর্তুকিযোগ্য হিসাবে সার্টিফিকেট দেওয়ার পরই তা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে রপ্তানিকারকের অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়। প্রতিটি রপ্তানি বিলের বিপরীতে দাবিকৃত নগদ সহায়তার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্সপোর্ট মনিটরিং সিস্টেমে ইএক্সপি সঠিকভাবে রিপোর্ট করা হয়েছে এবং অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের বিল অব এক্সপোর্টের তথ্য পাওয়া গেছে।

নগদ সহায়তার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট আপত্তি থাকায় এমটি এগ্রোর হিসাব থেকে গত ২ ডিসেম্বর ২ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির গৃহীত নগদ সহায়তার ৬ কোটি ১০ লাখ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত ব্যাংকের হিসাব থেকে স্থানান্তর করে সরকারি হিসাবে জমা নেওয়া হয়।

শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ৯ জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়েরের সুপারিশ করা হয়েছে। তারা হলেন-তাজুল ইসলাম টিপু, মোস্তফা কামাল, আলমগীর হোসেন, আবু বক্কর ছিদ্দিকী, ইব্রাহিম হোসেন, রাকিবুল ইসলাম রাসেল, জাকির হোসেন, নাফিজ ইকবাল ও বদরুল আলম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এমটি এগ্রো ফুড প্রোডাক্টের অংশীদার তাজুল ইসলাম টিপু বলেন, পণ্য রপ্তানি না করলে বিদেশ থেকে অর্থ প্রত্যাবাসিত হলো কীভাবে? রপ্তানির সপক্ষে সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরই ব্যাংক নগদ সহায়তা দিয়েছে। এখনে কোনো অনিয়ম হয়নি।

তৃতীয় দেশ থেকে টাকা আসার বিষয়ে তিনি বলেন, রপ্তানি অর্ডারে এ বিষয়ে উল্লেখ ছিল।

আরেক অংশীদার আলমগীর হোসেন বলেন, আমাদের লিয়েন ব্যাংক অডিটের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নগদ সহায়তার বিষয়ে আপত্তি দেওয়া হয়। আপত্তি দেওয়ার কারণ হলো, তৃতীয় দেশ থেকে এক্সচেঞ্জ হাউজের মাধ্যমে অর্থ দেশে পাঠানো হয়। এক্সচেঞ্জ হাউজের মাধ্যমে অর্থ পাঠানো হলে নগদ সহায়তা যে পাওয়া যায় না, তা জানা ছিল না। তাছাড়া যে সহায়তার টাকা দেওয়া হয়েছে, আমাদের লিয়েন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে সেই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক কেটে নিয়েছে। আমরাও ব্যাংককে ২ কোটি টাকার মতো ফিরিয়ে দিয়েছি। বাকি টাকা ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

শুনানিতে উপস্থিত না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যখন শুনানিতে ডাকা হয়, তখন করোনার প্রকোপ বেশি থাকায় উপস্থিত হতে পারিনি।

প্রসঙ্গত, রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে সরকার নগদ সহায়তা দিয়ে থাকে। বর্তমানে ৩৮টি পণ্য রপ্তানিতে ১ থেকে ২০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। চলতি অর্থবছরের বাজেটে নগদ সহায়তার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা।

দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন

উপরে