প্রকাশিত : ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৫:৫৪

তিন শতাধিক ভুক্তভোগীর হাজার কোটি টাকা হাওয়া

অনলাইন ডেস্ক
তিন শতাধিক ভুক্তভোগীর হাজার কোটি টাকা হাওয়া

বছর দশেক আগেও ঢাকায় এসে চালাতেন গাড়ি। কিন্তু দশ বছরের মাথায় কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। ১০০ গাড়ি নিয়ে শুরু করেন রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা। ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। নমিনেশন নিতে দিতে হয়েছে তাকে প্রডো গাড়ি।

আলোচিত এই ব্যক্তির নাম জাকির হোসেন। তিনি কুমিল্লার মেঘনা থানার দুই নম্বর মাইনকারচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। সুলভমূল্যে গাড়ি বিক্রি ও ভয়ংকর প্রতারণার অভিযোগে প্রতারক চক্রের মূলহোতা ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেনকে (৪৩) গ্রেফতার করেছে ডিএমপির গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের জোনাল টিম।

গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, তিন শতাধিক মানুষকে রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা ও স্বল্পমূল্যে গাড়ি কিনে বেশি মুনাফা লাভের ফাঁদে ফেলে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন। তার এমন প্রতারণার ফাঁদে সাধারণ মানুষ ছাড়াও সংসদ সদস্য, অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, প্রশাসনের লোক, এমনকি পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। তবে তাদের টাকা ফেরত দিলেও শত শত সাধারণ মানুষের টাকা আত্মসাৎ করেন জাকির।

শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোড ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি প্রধান) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, রেন্ট-এ-কারের ব্যবসার আড়ালে ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন। তিনি দুই তিন প্রক্রিয়ায় প্রতারণা করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্বল্পমূল্যে গাড়ির ব্যবসার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। গাড়ি রেন্ট-এ-কারে মাসিক ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ভাড়া দেওয়ার কথা বলে ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে কারো টাকা কারো গাড়ি হাতিয়ে নেন তিনি।

হারুন অর রশীদ বলেন, গত কয়েকদিনে ডিবি অফিসে দুই শতাধিক ভুক্তভোগী ভিড় করেছে। আমরা তদন্ত করতে দিয়ে জানতে পারলাম, শুধু মুন্সিগঞ্জের একটি গ্রাম থেকেই প্রায় দেড়শ মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক জাকির।

ডিবি প্রধান আরও বলেন, তার গাড়ি ২০ থেকে ২৫টি। সেসব গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাইকে দেখাতেন। প্রতারক জাকি কয়েকজন এমপি, প্রশাসনের লোকদের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছেন। তবে তাদের কাছে ভাবমূর্তি ঠিক রাখার জন্য মাসিক কিস্তির টাকা ঠিকই মাসে মাসে পরিশোধ করেছেন।

প্রাথমিক সত্যতার ভিত্তিতে ও রাজধানীর মুগদা থানায় এক ভুক্তভোগীর দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের তেজগাঁও জোনাল টিম বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে রেন্ট-এ-কার ব্যবসার আড়ালে ভয়ংকর প্রতারক জাকির চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করে।

গত বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে কুমিল্লা জেলার মেঘনা থানা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের সময় দুটি মাইক্রোবাস উদ্ধার করা হয়।

হারুন অর রশীদ বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জাকির চেয়ারম্যান স্বীকার করেছেন যে, প্রতারণার টাকায় গ্রামের বাড়িতে আলিশান বাড়ি বানিয়েছেন। ইউপি চেয়ারম্যান পদে নমিনেশন পেতে একজনকে প্রাডো গাড়ি দিয়েছেন। নির্বাচনে বিপুল টাকা খরচ করে চেয়ারম্যান হয়েছেন। ঢাকা শহরে তিনি বাড়ি, গাড়ি ও ফ্ল্যাট-প্লট কিনেছেন।

প্রতারণার টাকায় তিনি নিজের ছেলেকে আমেরিকায় পাঠিয়েছেন। আগামী নভেম্বরে তারও আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই আমরা তাকে গ্রেফতার করেছি। আমরা রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। ভুক্তভোগীদের টাকা ফেরতের চেষ্টা করা হবে। আর না হয় তার সম্পদ জব্দের জন্য প্রয়োজনে সিআইডিতে মামলা হস্তান্তর করা হবে।

আমরা এর আগেও তাকে গ্রেফতারে উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু অনেকে বলেছেন, তিনি গ্রেফতার হলে মাসিক কিস্তির টাকা পাবেন না। কিন্তু তিনি ভুক্তভোগীর মাসিক কিস্তির টাকা পরিশোধ করেননি।

তার প্রতারণা সম্পর্কে ডিএমপি ডিবি প্রধান বলেন, গ্রেফতার জাকির চেয়ারম্যান পোর্ট থেকে স্বল্প দামে গাড়ি কিনে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে টাকা নেয়। ক্রয় করা গাড়ি রেন্ট এ কারের মাধ্যমে মাসিক ভাড়ায় পরিচালনা করার জন্য চুক্তি করেন। একই গাড়ি দেখিয়ে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে চুক্তি করেন।

একই রেজিস্টেশন নাম্বার সম্বলিত গাড়ি একাধিক জাল দলিলের মাধ্যমে বিক্রি করে। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারো সঙ্গে শুধু ইঞ্জিন নাম্বার দিয়ে মাসিক কিস্তি পরিশোধের ভিত্তিতে কিছুদিন পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধ করে পরবর্তীতে কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে।

এছাড়াও আগের বিক্রি করা গাড়ি স্বল্পমূল্যে মালিকানা হস্তান্তরের লোভ দেখিয়ে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, গ্রেফতার জাকির চেয়ারম্যান প্রতারিত ভিকটিমদের কাছ থেকে পুরো টাকা নিয়ে ডাউন পেমেন্টে গাড়ি কিনতো। আবার ব্যাংক থেকে গাড়ির বিপরীতে কাস্টমারকে না জানিয়ে ব্যাংক লোন সুবিধা নিতো। দেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রায় ৩০০ ভিকটিমের সঙ্গে সে এমন প্রতারণা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে।

 দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন

উপরে