প্রকাশিত : ১০ নভেম্বর, ২০২২ ১১:১৩

বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন হত্যা, ‘খুনি টেকনোলজিক্যালি স্মার্ট’

অনলাইন ডেস্ক
বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন হত্যা, ‘খুনি টেকনোলজিক্যালি স্মার্ট’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশের (২৪) মরদেহ উদ্ধারের তিনদিন পার হলেও এখনো ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। রহস্য উন্মোচনে থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ, এলিট ফোর্স র‍্যাব, সিআইডিসহ একাধিক ইউনিট কাজ করছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকার শতাধিক সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ফারদিনের সর্বশেষ অবস্থান শনাক্ত ও তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করেও কাজ করছে পুলিশ।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ফারদিনকে যদি হত্যাই করা হয় তাহলে তা করেছে তার প্রতিপক্ষ কেউ। যে কি না টেকনোলজিক্যালি খুবই স্মার্ট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে কীভাবে খুঁজে বের করতে পারে সেসব বিষয়গুলো খুনি এড়িয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। ফারদিন নূর পরশকে কেউ হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে কি না এবং তার আত্মহত্যার বিষয়টি নিয়েও তদন্ত চলছে। এছাড়া সে কেরানীগঞ্জে কীভাবে গিয়েছিলেন, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

পুলিশ বলছে, যত স্মার্ট কিংবা চালাক প্রকৃতির হোক না কেন খুনিদের শনাক্তে বিশেষ কিছু দিক বিবেচনায় তদন্ত দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। কিছুটা দেরি হলেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। এ ঘটনায় বুশরা ও শীর্ষ সংশপ্ত নামে তার দুই বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা হয়নি। বান্ধবী বুশরা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী পরশ গত শনিবার (৫ নভেম্বর) থেকে নিখোঁজ ছিলেন। ওইদিনই রাজধানীর রামপুরা থানায় এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার বাবা কাজী নূর উদ্দিন। নিখোঁজের দুদিন পর গত সোমবার (৭ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিন নূর পরশের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ।

এ ঘটনায় রাজধানীর রামপুরা থানায় ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেছেন। বুধবার (৯ নভেম্বর) দিনগত রাতে নথিভুক্ত হওয়া এ মামলায় বুশরা নামে ফারদিনের এক বান্ধবীসহ অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে।  

ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা বিজনেস পত্রিকা ‘দ্য রিভারাইন’ এর সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন। ফারদিনের মা ফারহানা ইয়াসমিন গৃহিণী। তাদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা উপজেলার নয়ামাটিতে। তিন ভাইয়ের মধ্যে ফারদিন ছিলেন সবার বড়। তার মেজ ভাই আবদুল্লাহ নূর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ছোট ভাই তামিম নূর এবছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তবে জট খুলতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। বিভিন্ন পয়েন্ট ধরে কাজ চলছে। হয়তো খুনি ভেবেছে নদীতে ফেলে দিলে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হবে না।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, এটা যদি হত্যাকাণ্ডই হয় তাহলে নিহতের প্রতিপক্ষ কেউ তা করেছে। আর সেটি হয়তো তার পরিচিত কেউ। এক্ষেত্রে খুনি টেকনোলজিক্যালি খুবই স্মার্ট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে কীভাবে খুঁজে বের করতে পারে সেসব বিষয়গুলো খুনি এড়িয়ে চলবে এবং চলছে। এছাড়া নিহত ফারদিনের শরীর থেকে কোনো কিছু খুনি নেয়নি।

শতাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ-
রাজধানীর রামপুরা, ধানমন্ডি, পুরান ঢাকা, জুরাইন, ডেমরা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও ঢাকার বাইরেসহ বেশ কিছু এলাকার শতাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও এলিট ফোর্স র‍্যাব। এসব এলাকায় রিকশায় চড়তে ও হাঁটতে দেখা গেছে ফারদিনকে। প্রয়োজনে আরও এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করার কথা জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী-
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ফারদিন বাসা থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা বলে বের হলেও সেখানে যাননি। ৪ নভেম্বর বিকেলে বাসা থেকে বের হওয়ার পর তিনি ধানমন্ডি, টিএসসি ও পুরান ঢাকায় ঘোরাফেরা করেন।

সর্বশেষ পুরান ঢাকার জনসন রোড এরপর জুরাইন এলাকায় অবস্থান করেছিলেন তিনি। জুরাইন থেকে বুড়িগঙ্গা কাছাকাছি হলেও তার মরদেহ মিলেছে শীতলক্ষ্যা নদীতে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন, তার মরদেহ কীভাবে শীতলক্ষ্যায় গেল।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। পরের দিনের পরীক্ষার জন্য ৪ নভেম্বর ফারদিনের হলে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিনি হলে কেন গেলেন না?

ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসক বলছেন ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে-
গত মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) ময়নাতদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শেখ ফরহাদ বলেন, ময়নাতদন্তে আমরা দেখতে পেয়েছি, ফারদিনের মাথায় এবং বুকে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে সেই আঘাত কোনো ধারালো অস্ত্রের নয়। আঘাতের চিহ্ন দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে এটি হত্যাকাণ্ড। পুলিশের চাহিদা ও অধিকতর তথ্যের জন্য তথ্য-উপাত্ত ও আলামত মহাখালী ভিসিআরে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিবেদন পেলে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে ফারদিনকে কীভাবে খুন করা হয়েছে।

ডিসেম্বরে স্পেনে যাওয়া হলো না ফারদিনের-
ডিসেম্বরে স্পেনে অনুষ্ঠেয় ওয়ার্ল্ড ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেওয়ার কথা ছিল বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের। কিন্তু তার আগেই তিনি খুন হলেন। তিনি বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র এবং পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।

হাসপাতাল মর্গের সামনে কাঁদতে কাঁদতে পরশের বাবা নূর উদ্দিন রানা বলছিলেন, লাশ পাওয়া গেছে, যে সন্তানকে হারিয়ে ফেলেছি, এখন সে সন্তানকে তো আর ফিরে পাবো না। ডিসেম্বরে ওর ওয়ার্ল্ড ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার কথা ছিল। ডিবেটিংয়ে ফারদিন খুব ভালো ছিল। তার পাসপোর্ট রেডি হয়েছে, স্পেন যাওয়ার কথা ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়ার জন্য।

নূর উদ্দিন রানা আরও বলেন, ডিবেটিংয়ে ফারদিন খুব ভালো ছিল। আগামী মাসেই (ডিসেম্বরে) স্পেনে ওয়ার্ল্ড ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার কথা ছিল তার। তার পাসপোর্ট রেডি। শত্রুতার কারণে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। ওর লাশের সঙ্গে মানিব্যাগ, অকেজো মোবাইল, ঘড়ি সবই পাওয়া গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই।

তিনি বলেন, আমার ছেলে একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। বুয়েটে ভর্তি হলেও আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কারণে সে হলে থাকতে চাইতো না। বাসায় থেকেই ক্লাস করতো। ফারদিন ডিবেটিং ক্লাবসহ নানা ধরনের সোশ্যাল ওয়ার্কের (সমাজসেবা) সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। সে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিল না। ফারদিন টিউশনি করতো, বাসায় সে তার ভাইদের পড়ালেখায় সহযোগিতা করত। আমি আমার সন্তানকে ফিরে পাবো না। কিন্তু বিচার হোক, এটি চাই। মেধাবীদের ধরে ধরে হত্যা করা হচ্ছে, এটি বন্ধ হোক।

ডিএমপির গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) রাজিব আল মাসুদ বলেন, ফারদিন খুনের ঘটনায় ডিবির একাধিক টিম কাজ করছে। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আরও কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। শিগগির এর রহস্য উন্মোচিত হবে।

মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, ফারদিনের মোবাইল ফোনের লোকেশন চেক করে দেখা গেছে, ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিচরণ ছিল তার। তবে তা ফারদিনসহ নাকি তার মোবাইল অন্য কেউ বহন করেছে, তা তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে। কিছু সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে কাজ চলছে।

র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, বুয়েট শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় তার মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করছে র‍্যাবের একাধিক টিম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি প্রধান) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে- এটি হত্যাকাণ্ড। তবে এমন মেধাবী শিক্ষার্থীকে কে বা কারা, কী কারণে হত্যা করলো বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং আসামিকে আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে গোয়েন্দা টিম।

এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দুদিন আগে তার এক আত্মীয় আমাদের থানায় এসে রিপোর্ট করেছেন, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে তার লোকেশন দেখলাম তার এক বান্ধবীর বাড়ির কাছে। পরে তার মরদেহ পাওয়া গেল। এটা আমাদের ইনকোয়ারিতে আছে। সঠিক তথ্য পেলেই আপনাদের জানাবো।

 দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন

উপরে