ঢাকায় ২ কোটি লোকের বিঘ্ন সৃষ্টি করবেন, পুলিশ কি তাকিয়ে দেখবে?
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, ‘ঢাকা শহরে দুই কোটি লোকের বসবাস। সেই দুই কোটি লোকের বিঘ্ন সৃষ্টি করবেন, আর পুলিশ তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে?’
তিনি বলেন, ‘শুধু আমরা কেন, আপনারাও (বীর পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা) এটা সহ্য করবেন না। গত ১০ ডিসেম্বর আমরা শান্তিপূর্ণভাবে পার করেছি। ভবিষ্যতেও এমন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুলিশ সক্ষম।’
শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ‘মহান বিজয় দিবস ২০২২’ উপলক্ষে বীর পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে বীর পুলিশ মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ইতিহাস সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেন।
বীর পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘যে পুলিশের সূচনা ১৯৭১ সালে আপনারা করে দিয়েছিলেন ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রেখেছিলেন, জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন অনেকেই। সেই পুলিশের সদস্য হিসেবে গর্ব করে বলতে পারি যে, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক আপনারা সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১-২০২২ পর্যন্ত ধরে রেখেছি।’
খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, জাতির সব ক্রান্তিকালে ডিএমপি সর্বদা জাতির পাশে ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আপনারা যেভাবে একাত্তরে বুকের রক্ত বিলিয়ে দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, আপনাদের পরবর্তী প্রজন্ম তারাও জাতির সব ক্রান্তিলগ্নে জাতির পাশে ছিল। ২০১২-১৩ সালে অগ্নিসন্ত্রাসীরা পুলিশকে পুড়িয়ে মেরেছিল। কিন্তু পুলিশ দমে যায়নি, মনোবল হারায়নি। ২০১৫-১৬ সালে জঙ্গিবাদের সময় অনেক পুলিশ সদস্য মারা গেছেন। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধের যুদ্ধে আমরা হেরে যায়নি। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধের যুদ্ধে পুলিশ জয়ী হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে পুলিশ যেমন জীবন দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য, বিজয়ের জন্য যুদ্ধ করেছেন, আমরাও পরবর্তীতে বাঙালি জাতির জন্য সব ক্রাইসিস মোমেন্টে পাশে ছিলাম। অগ্নিসন্ত্রাসীদের যেমন আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়নি, তেমন জঙ্গিবাদকেও আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়নি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যদি কেউ ছিনিমিনি খেলতে চায়, বাংলাদেশ পুলিশ তা হতে দেবে না।’
ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘কয়েকবছর ধরে অনেক চেষ্টা করেছে, তারা পারেনি। আবার তারা নতুন খেলায় মেতে উঠেছে। নতুন খেলায় তাদের সফল হতে দেবো না।’
বীর পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে কমিশনার বলেন, ‘আপনারা এ বয়সেও লাঠি হাতে যুদ্ধের জন্য প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আমাদের সহকর্মীদের শরীরে টগবগে রক্ত, তারা কেন পারবে না? আপনাদের সাহসে এ তরুণ পুলিশ সদস্যরাই এ দেশকে সন্ত্রাস-জঙ্গিদের থেকে মুক্ত রাখবে ইনশাআল্লাহ।’
সাবেক পুলিশ সুপার বীর বিক্রম মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের যে কৃতিত্বময় গৌরবগাথা তা স্মরণ করতে হবে। এ কৃতিত্ব সৃষ্টি করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যেসব কুলাঙ্গাররা জাতির পিতাকে বিশ্বাস করতে চায় না, যারা বলে এ দেশ বাঙালিদের নয়; তাদের এ দেশে থাকার অধিকার নেই। তাদের দেশ থেকে উৎখাত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল পুলিশ বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম রক্ত ঝরেছিল রাজারবাগে। যতদিন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা রবে ততদিন বাংলাদেশ রবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু রবে।’
রাজারবাগ পুলিশের সাবেক ইন্সপেক্টর বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক বলেন, ‘একজন পুলিশ সদস্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি এজন্য গর্ববোধ করছি। আজ যারা আমাদের সম্মানিত করলেন, তাদেরও নিশ্চিয় আল্লাহ সম্মানিত করবেন। প্রয়োজন হলে দেশের জন্য আমরা আবারও একাত্তরের মতো ঝাঁপিয়ে পরতেও পারি।’
অনুষ্ঠানে সাহিত্যিক সারা জাকের বলেন, ‘আমার স্বামী আলী জাকের ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আলী জাকের থাকতেন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পাশে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছিল তা জেনেছি রাজারবাগে ছিলাম বলেই। আমার ভাই যুদ্ধে গিয়ে হারিয়ে গেছে। যখন গুলির শব্দ হতো, তখন আমি দৌড়ে গিয়ে ওড়না পরতাম। অনেক মা-বোনেরা তাদের ইজ্জত দিয়েছেন। ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে এ দেশ।’
প্রাক্তন পুলিশ সুপার বীর মুক্তিযোদ্ধা মালিক খশরু বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কথা বলা যাবে। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই ভাষণে আমরা পুলিশ বাহিনী অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিন আমি উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের চেয়ে আর কোনো বড় ভাষণ পাইনি, কোথাও নেই।’
মালিক খশরু আরও বলেন, ‘পুলিশ যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, সেভাবে পুলিশ বাহিনীকে কি আমরা সম্মানিত করতে পেরেছি? হয়তো পারিনি। বঙ্গবন্ধু নিজেই অসমাপ্ত, তাকে সমাপ্ত করবেন কীভাবে? বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা করে, লিখে শেষ করা যাবে না।’
সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি বীর মুক্তিযোদ্ধা সত্তরঞ্জন বাড়ৈ বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সেদিন খুব কাছ থেকে শুনেছি। ২৫ মার্চ যখন অ্যাটাক হলো, তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ হলে থাকতাম। রাতে ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ শুনলাম অ্যাটাক হয়েছে। মর্টার শেল দিয়ে জগন্নাথ হলের বিমগুলো ভেঙে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর বুটের শব্দ। ভয়ে আমরা তিন-চারজন আতঙ্কিত। লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে ফেললো পাকিস্তানি আর্মি। খুব জড়শড় হয়ে বসেছিলাম। কিন্তু অন্ধকার থাকায় তারা আমাদের দেখতে পেলো না। আর্মিরা চলে গেলো।’
সাবেক ডিআইজি জয়নাল আবেদীন বীর প্রতীক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ একটা বিরাট ও বিশাল কর্মকাণ্ড ছিল। একজন মেজর সাহেবের মুক্তিযুদ্ধ কমান্ড করার কোনো ক্ষমতা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধাদের গোলাবারুদ, খাওয়া দাওয়া কোনো মেজর করাননি, করেছেন আমাদের প্রবাসী ও ভারতীয়রা।’
সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি আব্দুল মাবুদ বলেন, চাকরি করাকালীন ৬৪ দেশ ভ্রমণ করেছি। অনেক দেশেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরেছি। পুলিশের চাকরির পর পাসপোর্ট বিভাগেও চাকরি করেছি। ডিজিটাল পাসপোর্ট আমার হাত ধরেই এসেছে।
সাহিত্যিক অধ্যাপক মোহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ছোট-ছোট বাচ্চা আমাকে বলে- স্যার আমরা কেন মুক্তিযোদ্ধা হতে পারলাম না। এখনকার প্রজন্ম নোবেল পাবে, বিশ্ব রেকর্ড করবে, ওয়ার্ল্ড কাপ খেলবে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবে না। যারা ১৯৭১ দেখেনি, তারা কল্পনাও করতেও পারবে না।
তিনি বলেন, আমার একজন আমেরিকান বন্ধু ছিলেন। তিনি সেই সময় বলেছিলেন- তোমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে মেয়েদের রেপ করা হয়েছিল, যারা শহীদ হয়েছিলেন, একটা সময় এসব অনেকে বিশ্বাস করবে না। এখন এসে দেখছি, আমার বন্ধুর কথা ঠিক। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।’
জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমার বন্ধুরা যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মারা গেছেন, তারা অন্তত শান্তিতে দেখতে পারছেন রাজাকারদের শাস্তি হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের (নতুন প্রজন্ম) হাতে একটি স্বাধীন দেশের পতাকা দিয়ে গেছেন। এটি রক্ষা করবে।’
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এ কে এম হাফিজ আক্তার, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (লজিস্টিকস, ফিন্যান্স অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) সৈয়দ নুরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার, উপ-পুলিশ কমিশনারসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন