ভারতের সহযোগিতা ছাড়া ৯ মাসে স্বাধীনতা পেতাম না: মোজাম্মেল হক
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত যদি মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সহযোগিতা না করতো তাহলে মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা পেতাম না। সে জন্য ভারতের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। তৎকালীন মুজিবনগর সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোড দিয়েছিল ভারত, এর জন্যও আমরা দেশটির প্রতি কৃতজ্ঞ।
শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম কেন্দ্রীয় সংসদ আয়োজিত ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সহযোগিতায় বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ভেঙে দুই ভাগ করেছিল। তখন দুই জাতিসত্তার ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়। কিন্তু পাকিস্তানিরা শুরু থেকেই আমাদের ওপর নির্যাতন-জুলুম শুরু করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পরও ঠুনকো অজুহাতে আদমজী জুটমিলে দাঙ্গা লাগিয়ে দিয়েছিল। তখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধু ছয়দফা দেন। তার জন্য বঙ্গবন্ধুকে জেলে যেতে হয়। ১৯৬৯ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতলেও আমাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি পাকিস্তানিরা। কারণ তারা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যেই ছিল মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা। ২৬ মার্চ আসে স্বাধীনতার মূল ঘোষণা, আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মিত্রবাহিনীর যেসব সদস্য জীবন দিয়েছিলেন তাদের স্মৃতির জন্য আশুগঞ্জে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করছি। যার উদ্বোধন করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভারতের সঙ্গে পানি সমস্যা এখনো বিদ্যমান। আমরা আশা করি কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে পানি সমস্যার সমাধান হবে এবং এর মাধ্যমে দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হবে।
আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সন্তানদের জন্য মুজিব স্কলারশিপ দেওয়া হবে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা পয়সায় ভারত চিকিৎসা দিয়ে থাকে। আমরা আশা করছি আমাদের দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত সুন্দর ও পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ। এখনকার এই দুই প্রজন্মের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তার আরও দৃঢ় হবে। তাদের মাধ্যমে আমাদের সম্পর্ক আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এই কামনা করছি এবং তাদের সফলতা কামনা করছি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচয়িতা সংবিধান প্রণেতা ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। এ সময় প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মিত্রবাহিনী সদস্য সন্তানদের মধ্য থেকে উপস্থিত ছিলেন শ্রী জয়দীপ মুখার্জী, ড. মানস ব্যানার্জী, কবি বিশ্বনাথ লাহা, সুপর্ণা ব্যানার্জী, সুরুজ দাস, উপাসনা ব্যানার্জী। এছাড়া সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সম্পাদকমণ্ডলীর সাবেক সদস্য ফজলে আলী, ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের, বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. আব্দুল বাতেন, ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর প্রমুখ। মূল বক্তব্য ও প্রবন্ধ উপস্থাপান করেন মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন পর্ষদের প্রধান সমন্বয়কারী মেহেদী হাসান।
অনুষ্ঠান উপস্থাপন করেন বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন পর্ষদের কর্মসূচি সমন্বয়ক ও মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম কেন্দ্রীয় সংসদের মহাসচিব মো. সেলিম রেজা। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাসুদ রানা। অনুষ্ঠান শেষে আগত অতিথিদের ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়।
মূল বক্তব্য ও প্রবন্ধে মেহেদী হাসান বলেন, আমাদের পিতারা মুক্তিযুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন করেছেন। তাদের সম্মানেই আমাদের এই আয়োজন। পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালির জাতিসত্তায় আঘাত হানে। তারা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। মায়ের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, শফিক, জব্বারসহ অনেকে। রাষ্ট্র গঠনে মূল ভূমিকা রাখেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ মার্চের ভাষণের পর পুরো জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের থাকা-খাওয়াসহ নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। তার জন্য ভারতের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা সব শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। আমরা আগামী ৯ মাস ধরে এবার বিজয় উদযাপন করবো।
মিত্রবাহিনীর সদস্যের সন্তান কলকাতার সুপর্ণা ব্যানার্জী বলেন, আমার বাবা ১৯৭১ সালের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এ জন্য আমি গর্বিত। দুই বাংলার সমন্বয়কারী হিসেবে আমি কাজ করতে চাই। এ জন্য আমি সবার সহযোগিতা চাই।
বাংলাদেশ-ভারত সম্প্রীতি পরিষদের সমন্বয়ক ড. ফজলে এলাহী বলেন, এখন ভূরাজনৈতিক মেরুকরণের চেষ্টা চলছে। নানা রকম ষড়যন্ত্র হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে আমাদের ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সজাগ থাকতে হবে। জামায়াত-শিবির সারাদেশে অপপ্রচারে লিপ্ত। ব্যাংকে টাকা নেই বলে অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদেরও তাদের পাল্টা প্রচার করতে হবে, তাদের অপপ্রচার রুখতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।
ভারত থেকে আগত কবি বিশ্বনাথ লাহা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমাদের বালুরঘাটে একটি অস্ত্র কারখানা ছিল। সেখানে আমরা বাঙ্কার তৈরি করে যুদ্ধ করেছিলাম। অনেকই বলে বাংলাদেশের উন্নতি হয়নি কিন্তু আমি এসে বাংলাদেশের উন্নতি দেখে মুগ্ধ।
পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ সাংবাদিক ড. মানস ব্যানার্জী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, তখন রেডিও বাংলাদেশ থেকে গান বাজানো হতো। এসব গানে আমরা উদ্বুদ্ধ হতাম। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমি, শেখ কামালসহ আরও কয়েকজন যশোর হয়ে বাংলাদেশে ঢুকি। আমরা যশোরে ঢুকেই দেখলাম চারদিকে পচা গন্ধ, রাস্তায় রাস্তায় লাশ। ঘরে ঘরে লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি আমরা। আমরা তখন ঢাকায় আসতে চাইলাম, কিন্তু অনেকেই বাধা দিল। পরে হেলিকপ্টারে করে শেখ কামালকে ঢাকায় পাঠানো হলো। পরে আমরা সাতক্ষীরা এলাকায় গিয়ে দেখেছি নারীর মরদেহ পড়েছিল। দেখে বুঝেছি নারীদের ওপর পাকহানাদাররা কতটা নির্যাতন করেছিল। সে দৃশ্য মনে পড়লে এখনো আমার চোখে জল চলে আসে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়দীপ মুখার্জী বলেন, বাংলাদেশের ৫০ বছরের বিজয়ের উৎসবে উপস্থিত হতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। যুগ যুগ ধরে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বজায় থাকবে, এ সম্পর্ক কেউ বিনষ্ট করতে পারবে না।
অনুষ্ঠানের সূচনা হয় সকাল ৯টায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান শিখাচিরন্তনে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে। সকাল ১০টায় জাতীয় ও সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় আলোচনাসভা শুরু হয়। দুপুর দেড়টায় সম্প্রীতি শোভাযাত্রা (ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ধানমন্ডি ৩২) অনুষ্ঠিত হয়। পরে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়। বিকেলে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ হয় দিনব্যাপী অনুষ্ঠান।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন