মামলা ছাড়া র্যাব কাউকে গ্রেফতার করতে পারে কি না
মামলা ছাড়া কারও অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কাউকে গ্রেফতার বা আটক করতে পারে কি না সে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কাউকে গ্রেফতারের এখতিয়ার র্যাবের আছে কি না, সে প্রশ্নও তুলেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
হাইকোর্ট বলেছেন, ‘আমাদের জানা দরকার তার (সুলতানা জেসমিনের) মৃত্যু কীভাবে হয়েছে। পত্রপত্রিকায় এসেছে, দেশের মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, পুরো দেশবাসীর সঙ্গে আমারও প্রশ্ন। এছাড়া গ্রেফতারের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার বিষয়টিও আমাদের নজর কেড়েছে।’
নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের (৪৫) মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়ার রিট শুনানিতে মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) এমন প্রশ্ন তোলেন হাইকোর্ট।
উচ্চ আদালত বলেন, ‘যেকোনো নাগরিক যত জঘন্য অপরাধই করুক না কেন, তার জন্য আইন আছে, বিচার আছে এবং অপরাধীর বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। সবচেয়ে বড় কথা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ সবার জন্যই প্রযোজ্য। এ মৃত্যুতে মামলা হবে কী হবে না সেটা রাষ্ট্র এবং ওই নারীর আত্মীয়স্বজনের বিষয়। আমাদের জানা দরকার তার মৃত্যু কীভাবে হয়েছে।’
গত ২২ মার্চ ১২টার দিকে আটকের পর গত ২৪ মার্চ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিনের। আটকের পর সুলতানা জেসমিনকে সম্মানজনক জায়গায় (থানা অথবা কার্যালয়ে) নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল কি না এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ের ব্যবহার আইনানুগ হয়েছে কি না, হাইকোর্ট সে প্রশ্নও রেখেছেন রাষ্ট্রপক্ষের অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিনের কাছে।
আগামী ৫ এপ্রিল পরবর্তী শুনানির তারিখ রেখে এসময়ের মধ্যে এসব প্রশ্ন সংক্রান্ত আইন, নথি ও সুলতানা জেসমিনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
নওগাঁ সদরে র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু সংক্রান্ত প্রকাশিত খবর-প্রতিবেদন সোমবার (২৭ মার্চ) নজরে এনে আদালতের স্বপ্রণোদিত আদেশ চেয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। বিষয়টিতে শুনানির পর হেফাজতে ওই নারীর মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কি না এবং মৃত্যুর কারণ জানতে সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেখতে চান আদালত।
সুলতানা জেসমিনকে আটকের কারণ, স্থান, সময়, হেফাজতে নেওয়ার কারণ, জিজ্ঞাসাবাদ সুনির্দিষ্ট তথ্যও চান আদালত। আর এসব তথ্য জানাতে রাষ্ট্রপক্ষকে একদিনের সময় দেওয়া হয়। আর আদালতের দৃষ্টিতে আনা ওই আইনজীবীকে বলা হয় রিট আবেদন প্রস্তুত করে নিয়ে আসতে। নির্দেশমতো মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) আদালতে প্রতিবেদন দেয় রাষ্ট্রপক্ষ। সেখানে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছিল না। অন্যদিকে র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর কারণ ও র্যাবের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক।
আদালতে এদিন রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ (এসকে) মোরশেদ। সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জেনারেল আবুল কালাম খান দাউদ ও মোহাম্মদ সাইফুল আলম।
মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটায় শুনানি শুরু হলে রিটকারী আইনজীবী আবেদনের আরজি তুলে ধরে বলেন, ‘এ ঘটনায় কোনো বিষয়ই বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। র্যাব গঠন করা হয়েছিল দাগি চোর-ডাকাত, মাদক চোরাকারবারি ধরতে। এ নারীকে (সুলতানা জেসমিন) আটক করা হয় ২২ মার্চ। আর ২৪ মার্চ তার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এ আইনে কাউকে গ্রেফতারের এখতিয়ার পুলিশের থাকলেও র্যাবের নেই। তাছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা অনুসারে সুলতানা জেসমিনকে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোনো অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতেই র্যাব এ ধরনের বেআইনি ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা আজ অসহায়। র্যাব যাকে ইচ্ছা তাকে তুলে নিয়ে উধাও করে দিচ্ছে। এটি (সুলতানা জেসমিনকে আটক, হেফাজত, জিজ্ঞাসাবাদ) সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে করা হয়েছে। তাছাড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সুলতানা জেসমিনের মাথায় আঘাত থাকার কথা বলেছেন, যা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসেছে। ফলে র্যাবের কর্মকাণ্ড ও নারীর মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন। যে কারণে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিটে।’
এরপর শুনানিতে আসেন অ্যাটর্নি জেনারেল। নওগাঁ সদর হাসপাতালে চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সুলতানা জেসমিনের উচ্চ রক্তচাপ ছিল। তার মৃত্যু হয়েছে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে।’
সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র তুলে ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘এক ব্যক্তির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ মার্চ ১১টা ৫০ মিনিটে নওগাঁ সদরের নওজোয়ান মাঠের সামনে থেকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা অনুসারে সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়। পরে জনসাধারণের সামনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব। তার আগে আটক ওই নারীর মোবাইল ফোন থেকে অভিযোগ সংক্রান্ত তথ্য ও নথি উদ্ধার করা হয়।’
২৪ ঘণ্টার বেশি সময় র্যাব ওই নারীকে আটকে রাখেনি দাবি করে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন বলেন, ‘পুলিশে সোপর্দ করতে থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে আটক নারী অসুস্থ হয়ে পড়লে দুপুর সোয়া ১টায় প্রথমে তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তার রক্তচাপ ছিল ৯০/৬০। এরপর ওইদিন রাত ৯টা ২০ মিনিটে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তিতে রক্তক্ষরণ জনিত সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে এটি সম্পূর্ণভাবে ভুল যে, ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ওই নারীকে রাখা হয়েছে।’
শুনানির এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘কোনো অনুমানের ভিত্তিতে আমরা ঘটনাটি বিবেচনা করবো না। আটকের পর তাকে পুলিশে সোপর্দ করার কথা। সেটি কিন্তু প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়েছেন। তার মাথায় আঘাতের কথা বলা হচ্ছে। দেশবাসীর প্রশ্ন, তাকে নির্যাতন করা হয়েছিল কি না। সেটি আমাদের নজরে এসেছে। বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। তার জন্য ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আমরা দেখতে চাই। তাছাড়া, র্যাব গঠন-নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনটিও দেখতে চাই যে, সে আইনে র্যাবকে কী কী এখতিয়ার, ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। দেখতে চাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় র্যাব কাউকে আটক করতে পারে কি না, জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে কি না।’
আদালত বলেন, ‘যে কারণে র্যাবের এখতিয়ার জানাটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখেতে চাই মামলা ছাড়া কারও কোনো অভিযোগে র্যাব কাউকে আটক বা গ্রেফতার করতে পারে কি না। স্বীকারোক্তি নিতে পারে কি না।’
আদালত বলেন, ‘কেউ যেন ভিকটিমাইজ না হয়। সেজন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের কাজও সেটি। কোনো নাগরিক যত জঘন্য অপরাধই করুক না কেন, তার জন্য আইন আছে, বিচার আছে এবং অপরাধীর বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। সবচেয়ে বড় কথা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ সবার জন্যই প্রযোজ্য। এ মৃত্যুতে মামলা হবে কী হবে না সেটা রাষ্ট্র এবং ওই নারীর আত্মীয়স্বজনের বিষয়। ঘটনার পর পুরো দেশবাসীর মধ্যে একটা প্রশ্ন উঠেছে, সেটি আমারও প্রশ্ন তার (নারীর) মৃত্যু কীভাবে হয়েছে। গ্রেফতারের পর হাসপাতালে নেওয়ার বিষয়টিও আমাদের নজরে এসেছে।’
তখন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দাখিলে সময় চাইলে আদালত আগামী ৫ এপ্রিল দুপুর ২টায় পরবর্তী শুনানির তারিখ রাখেন।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন