জাহাজ নিয়ে ঘুরছে জলদস্যুরা, ঈদের আগে মুক্তির আকুতি বন্দী নাবিকদের
ভারতীয় ও ইউরোপিয়ান নৌবাহিনীর তৎপরতার কারণে ভারত মহাসাগরে ছিনতাইয়ের পর এমভি আব্দুল্লাহকে নিয়ে শুক্রবার (১৫ মার্চ) থেকে এ পর্যন্ত দু’বার স্থান পরিবর্তন করেছে জলদস্যুরা। সবশেষ সেটি রাখা হয়েছে সোমালীয় উপকূলে তীর থেকে ৫ নটিক্যাল মাইল দূরে। নিজেদের এলাকায় অবস্থান করলেও নিরাপত্তা শঙ্কায় বারবার স্থান পরিবর্তন করছে তারা।
এদিকে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ নাবিক ঈদের আগেই প্রিয়জনের কাছে ফিরতে চান। ভয়েস মেসেজ ও ফোনে স্বজনদের কাছে তাদের আকুল এই ইচ্ছার কথা জানাচ্ছেন। বাংলাদেশে উৎকণ্ঠায় থাকা নাবিক পরিবারগুলোও চাইছে তাদের স্বজনরা ঈদের আগেই ফিরে আসুক। না হয় তাদের জন্য এবার ঈদের আনন্দ বলে কিছুই থাকবে না। তারা জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে সরকার ও মালিকপক্ষের তৎপরতা আরও বাড়ানোর আকুতি জানান।
যদিও সরকার ও মালিকপক্ষ বলছে, জিম্মি নাবিক ও জাহাজ উদ্ধারে তাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জিম্মিদের বিষয়ে সংবাদ প্রচারে গণমাধ্যমকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মাহবুবুর রহমান বলেন, সমঝোতা প্রক্রিয়া তারা তখনই শুরু করবে, যখন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিত হবে। এখনো জাহাজটি স্থিতিশীল নয়। প্রথমে সেটি নিয়ে যেখানে ওরা ভিড়িয়েছিল, এখন সেখান থেকে সরে গেছে। ইউরোপিয়ান ও ভারতীয় নৌসদস্যদের পর্যবেক্ষণ করছে জলদস্যুরা। ফলে এখনই তারা শক্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে হয় না।
আব্দুল্লাহকে উপকূলে নেয়ার পথে ২৩ নাবিককে উদ্ধারে কয়েক দফা তৎপরতা চালায় ভারত ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নৌবাহিনী। তবে নাবিকদের জীবনের ঝুঁকি থাকায় পিছু হটে নৌসদস্যরা। কিন্তু এখনো নজরদারিতে থাকলেও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো দেশের জলসীমার ১২ নটিক্যাল মাইলের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ নেই। তাই অনেকটা জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণেই আছে জাহাজটি।
ছিনতাই হওয়া জাহাজ ছাড়াতে মধ্যস্থতাকারীর কাজ করে ইউরোপ-আমেরিকার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। জলদস্যুরা এখনো যোগাযোগ না করলেও এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে রাখছে মালিকপক্ষ। ইঞ্জিনিয়ার মাহবুবুর রহমান বলেন, লন্ডন ও হিউস্টনের দুটি প্রতিষ্ঠান এসব সমঝোতা করে। এখন পর্যন্ত সোমালিয়ান দস্যুরা যত জাহাজ জিম্মি করেছে, সবই ছাড়িয়েছে তারা।
কবির গ্রুপের মিডিয়া অ্যাডভাইজর মিজানুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক যেসব সংস্থা রয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি আমরা। সারা বিশ্বে এরকম ৫০ থেকে ৬০টি লবিস্ট আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি।
অন্যদিকে জাহাজে আটক এক নাবিক ভয়েস মেসেজে বলেছেন, ‘একটি ওয়াশরুম ব্যবহার করি সবাই। বড় বড় ফ্রিগেট আসছে দুইটা। একদম সব ইক্যুইপমেন্টস নিয়ে। কিন্তু ওরা ভয় পায় না এগুলো। ওরা আমাদের মাথায় গুলি ধরে রাখে। বড় বড় মেশিনগান গান তাক করে রাখছে। এ অবস্থায় ঘুম যা হওয়ার হচ্ছে। যেহেতু জলদস্যুরা আমাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করছে, আমাদের পানি ব্যবহার করছে। ১৫ দিন পর খাওয়া-দাওয়া যখন শেষ হয়ে যাবে তখন আমরা খুব কষ্টে পড়ে যাব।’
চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খানের ভাই আসিফ নুর বলেন, শুক্রবার (১৫ মার্চ) বিকালে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এক মিনিট কথা বলেছেন তার ভাই। সবার আগে পানি সংকটে পড়বেন বলে জানিয়েছেন। একসঙ্গে ৪০ জন খাওয়া-দাওয়া করার কারণে দ্রুত খাদ্য ফুরিয়ে যাচ্ছে বলেও জানিয়েছেন। এ অবস্থায় ঈদের আগেই যাতে তাদের মুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয় সেই আকুতি জানিয়েছেন চিফ অফিসার।
বন্দি নাবিকদের স্বজনদের বরাতে জানা গেছে, ডিউটিরত নাবিকদের কেবিনে থাকতে দেওয়া হলেও অন্য নাবিকদের থাকতে দেয়া হচ্ছে ইঞ্জিন রুমে গাদাগাদি করে। জাহাজের ক্যাপ্টেন ও চিফ অফিসারকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রেখেছে। জলদস্যুদের নির্দেশ ছাড়া তাদের ঘাড় ফেরাতে দেওয়া হচ্ছে না। এদিক-ওদিক করলেই রাইফেলের বাঁট দিয়ে গুঁতো দেওয়া হচ্ছে। কেবিনে থাকা নাবিকদের এক-দুই ঘণ্টা পরপর এসে নক করে যাচ্ছে জলদস্যুরা।
নাবিক পরিবারের সদস্যরা জানান, এ অবস্থায় দিন যতই যাচ্ছে জিম্মি নাবিকদের মানসিক অবস্থা ততই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাদের উদ্ধারে মালিকপক্ষ ও সরকার যাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয় সেই আকুতি জানিয়েছেন জিম্মি এই নাবিক পরিবারের সদস্যরা।
প্রসঙ্গত, গতকাল শনিবার (১৬ মার্চ) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের প্রধান রিয়ার এডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম গণমাধ্যমকে জানান, বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার মুহূর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি জাহাজ অ্যাকশনে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের অনুমতি চেয়েছিল। তবে নাবিক, ক্রু এবং অন্যদের প্রাণনাশের আশঙ্কায় বাংলাদেশ সরকার অ্যাকশনের অনুমতি দেয়নি।
তিনি বলেন, ঘটনার পরপরই ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমান পুরো এলাকা সার্চ করে আমাদের জাহাজটি সোমালি দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে সেই তথ্য নিশ্চিত করে। সেখানে কাছাকাছি ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি জাহাজ তাৎক্ষণিক দস্যুদের চ্যালেঞ্জ করার জন্য আমাদের অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু আমাদের লোকজনের প্রাণরক্ষায় আমরা সে পথে যাইনি। এখন নেগোশিয়েশন চলছে কীভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নাবিক, ক্রুদের কোনো রকম ক্ষতি ছাড়াই জাহাজটি উদ্ধার করা যায়।
তিনি আরও বলেন, জাহাজ চলাচল নির্বিঘ্ন এবং নিরাপদ রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি দেশের টহল জাহাজ গভীর সমুদ্রে থাকে। এসব জাহাজের বিশেষ কাজ জলদস্যুতা প্রতিরোধ করা। তবে হুতিদের প্রতি এটেনশন দিতে কিছু জাহাজ ব্যস্ত থাকার গ্যাপে সুযোগ নিয়েছে সোমালিয়ান জলদস্যুরা। বেশ কয়েক মাস যাবত তারা বড় জাহাজ জিম্মি করার অপেক্ষায় ছিল। সাগরের প্রায় ১৩০০ নটিক্যাল মাইল ভেতরে গিয়ে তারা আক্রমণটি করেছে।
এর আগে শনিবার (১৬ মার্চ) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, নাবিকসহ জাহাজটি মুক্ত করতে বসে নেই সরকারও। তবে এ ঘটনার সংবাদ প্রচারে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করেন তিনি। ড. হাছান বলেন, যখন এ বিষয়ে অতি গুরুত্ব দেয়া হয় এবং এ নিয়ে পরিবারের স্বজনদের প্রতিক্রিয়া দেখেন, তখন নাবিকরা বেশি আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। এই নেতিবাচক জিনিসটা দেখা যাচ্ছে। সুতরাং এ নিয়ে সরকার কাজ করছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত সুস্থ আছেন সব নাবিক। যার বার্তা পাঠানো হয়েছে স্বজন ও মালিকপক্ষের কাছে।
উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বাংলাদেশ সময় বেলা দেড়টার দিকে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুরা বাণিজ্য জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ নেয়। জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাচ্ছিল।
দৈনিক চাঁদনী বাজার / সাজ্জাদ হোসাইন