মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: তথ্য বিভ্রান্তির সতর্ক সংকেত

রাজধানীর উত্তরা এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি তথ্যমতে, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৩১ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক, যাদের বেশিরভাগই শিশু শিক্ষার্থী।
দুর্ঘটনার পরপরই শুরু হয় উদ্ধারকাজ, চিকিৎসা সহায়তা, মৃতদের পরিচয় শনাক্তকরণ এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারি সর্বোচ্চ প্রস্তুতি। তবে এর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক গুজব, বিভ্রান্তিকর ছবি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি ভিডিও এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে।
বিভ্রান্তিকর ভিডিও ও ছবি
দুর্ঘটনার দিন একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায় একটি যুদ্ধবিমান ভবনে আঘাত করে বিস্ফোরিত হচ্ছে। ক্যাপশনে দাবি করা হয়—এটিই মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের দৃশ্য।
তবে রিউমর স্ক্যানার টিম ভিডিও বিশ্লেষণে দেখতে পায়, এটি একটি এআই টুল (গুগলের ‘ভিইও’) দিয়ে তৈরি করা কনটেন্ট। ভিডিওতে ‘এআই জেনারেটেড’ ট্যাগ ও ‘ভিইও’ ওয়াটারমার্ক রয়েছে। এছাড়া ভিডিওতে দেখা যাওয়া বিল্ডিংটি মাইলস্টোন স্কুল নয়, বরং ‘ইউএনটিআইই কলেজ’ লেখা বিশিষ্ট এক ভবন।
একইভাবে, একটি শিশু আহত হওয়ার ছবি শেয়ার করে দাবি করা হয়, সেটি বাংলাদেশের দৃশ্য। অথচ ফ্যাক্টচেকে দেখা যায়, এটি ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আহত শিশুদের ছবি, যা নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।
মিথ্যা পরিচয় ও গুজবের নেপথ্য
একজন নারীকে প্রশিক্ষিত পাইলট বলে দাবি করে একটি পোস্ট ছড়ায়, যেখানে বলা হয়—ঘটনাটি একটি ‘সুপরিকল্পিত মিলিটারি-পি আর অপারেশন’। ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি ভারতীয় নাগরিক রোকেয়া দেশাই, যিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্যই করেননি। তাঁর পরিচয় ও ছবি ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়।
এছাড়া ‘অ্যানোনিমাস মেইন পেজ’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে দুর্ঘটনার আগের দিন দেওয়া হয় ‘একটি স্কুল ধসে বহু শিশু মারা যাবে’ ধরনের পোস্ট। পরদিন দুর্ঘটনার পর তারা দাবি করে, ‘আমরা আগেই সতর্ক করেছিলাম।’ বিশ্লেষক কদরুদ্দিন শিশির জানান, এই পেজটির কোনো সম্পর্ক নেই আন্তর্জাতিক ‘অ্যানোনিমাস হ্যাকার গ্রুপ’-এর সঙ্গে। বরং এটি অনলাইন জুয়া সংক্রান্ত পোস্ট করে এবং হাওয়াই, নাইজেরিয়া ও অজ্ঞাত স্থান থেকে পরিচালিত হয়।
আরেকটি ফেসবুক আইডি ‘মতিউর রহমান’ থেকে বিমান বিধ্বস্তের আগাম ভবিষ্যদ্বাণীর দাবি করে স্ক্রিনশট ছড়ানো হয়। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৮ জুলাই দেওয়া ওই পোস্ট ২১ জুলাইয়ের পর একাধিকবার সম্পাদনা করে বিভ্রান্তিকর তথ্য সংযুক্ত করা হয়।
সরকার ও বিশেষজ্ঞদের অবস্থান
মর্মান্তিক দুর্ঘটনার মধ্যেই এমন গুজব ছড়িয়ে শোককে রাজনৈতিক ও ষড়যন্ত্রমূলক মোড় দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মত দিয়েছে সরকার ও বিশ্লেষকেরা।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক বিবৃতিতে জানান, “নিহত ও আহতদের সহায়তায় সরকার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিচ্ছে। শনাক্ত না হওয়া মরদেহের ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে। বিভ্রান্তিকর তথ্য ও লাশ গুমের গুজব সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।”
তিনি আরও জানান, স্কুল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে এবং নিখোঁজদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। কোনো অভিভাবক তার সন্তান বা স্বজনকে না পেলে গণমাধ্যমের মাধ্যমে তা জানানো সম্ভব—এ অবস্থায় লাশ লুকানোর অভিযোগ অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
সামাজিক দায়বদ্ধতার আহ্বান
গুজব, অপপ্রচার ও ভুয়া কনটেন্ট শুধু দুর্ঘটনার শিকার পরিবার নয়, গোটা সমাজের মানসিক ভারসাম্য ও তথ্যের প্রতি আস্থাকে নষ্ট করে দেয়। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের পাশাপাশি সচেতন নাগরিক ও গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো—তথ্য যাচাই ছাড়া কিছু না ছড়ানো এবং বিভ্রান্তি রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করা।