প্রকাশিত : ৩১ জুলাই, ২০২৫ ০২:০৩

ইন্টারনেট বন্ধের সেই দিনগুলো: স্মৃতির কালো অধ্যায়

সঞ্জু রায়, বগুড়া:
ইন্টারনেট বন্ধের সেই দিনগুলো: স্মৃতির কালো অধ্যায়
ইন্টারনেট বন্ধের প্রতীকি ছবি। - সংগৃহীত

জুলাই এলেই আন্দোলনকারীদের মনে পড়ে যায় সেই বিভীষিকাময় ইন্টারনেট বিভ্রাটের দিনগুলোর কথা। ছাত্র-জনতার কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন গণআন্দোলনের রূপ নেয়, তখনই রাষ্ট্রযন্ত্রের চরম নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ হিসেবে বন্ধ করে দেওয়া হয় দেশের মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। সাধারণ মানুষের তথ্যপ্রবাহ, যোগাযোগ, সংবাদ ও অভিব্যক্তির অধিকারকে স্তব্ধ করে দেওয়ার এমন নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।

১৬ জুলাই আবু সাঈদের মৃত্যুর পর রাজপথে গর্জে ওঠে শিক্ষার্থীরা। ১৭ জুলাই আংশিক ইন্টারনেট বন্ধ হলেও ১৮ জুলাই বিকেল থেকে রাত ৯টার মধ্যে মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড উভয় সংযোগই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, যা স্থায়ী ছিল ২৮ জুলাই পর্যন্ত। এক পর্যায়ে ২৪ জুলাই কিছু সরকারি দপ্তরে ব্রডব্যান্ড চালু করা হলেও ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ছিল পুরোপুরি বন্ধ। পরে ৩১ জুলাই প্ল্যাটফর্মগুলো খুলে দেওয়া হলেও নেটের গতি ছিল অত্যন্ত ধীর। আন্দোলন তীব্র হলে ৪ আগস্ট ফের বন্ধ করে দেওয়া হয় ফোর-জি নেটওয়ার্ক, যা স্বাভাবিক হয় ৫ আগস্ট দুপুরে।

ভয়ের মধ্যে ছিল সংগঠন, ছিল প্রতিবাদ

ভয়, গ্রেপ্তার আতঙ্ক আর তথ্যপ্রবাহহীন পরিবেশেও থেমে থাকেনি শিক্ষার্থীদের সংগঠন ও প্রতিবাদ। বগুড়া থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সদস্য সচিব সাকিব খান বলেন,
“সভ্য কোনো দেশে এমনভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করার নজির নেই। আমাদের সহযোদ্ধাদের উপর যখন বুলেট ছোড়া হচ্ছিল, তখন আমরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। VPN দিয়েও ব্যর্থ হচ্ছিলাম। মোবাইলে যোগাযোগ করলে সেই তথ্য চলে যাচ্ছিল গোয়েন্দাদের কাছে।”

আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী বিপ্লব বলেন,
“ইন্টারনেট বন্ধ করে তারা শুধু আমাদের নয়, পুরো জাতিকেই অন্ধকারে রেখেছিল।”

তথ্যবিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতার বিভীষিকা

বগুড়া জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসান বলেন,
“যখন আন্দোলন এক দফার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল, তখন ১২টি উপজেলার নেতা-কর্মীরা রাজপথে নেমে আসে। সরকার তখন ভেবেছিল আন্দোলনের নির্দেশনা বিদেশ থেকে আসছে—এই অজুহাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তারপরও তারা আন্দোলন থামাতে পারেনি।”

ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে দেশের ব্যাংকিং সেবা, আমদানি-রপ্তানি, কাস্টমস, স্বাস্থ্য, টেলিমেডিসিনসহ একাধিক খাত স্থবির হয়ে পড়ে। ই-ক্যাবের তথ্য মতে, ওই কয়েকদিনে ই-কমার্স খাতেই ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে ফিরেছিল সনাতনী দিন

পত্রিকার মালিক ও সাংবাদিকদের জন্য সেই সময় ছিল এক দুঃস্বপ্ন। ইন্টারনেট ছাড়া সংবাদ প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। বগুড়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কালাম আজাদ বলেন,
“গুজবের বন্যা বইছিল। আমরা চাইলেও সঠিক তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। অনেক গণমাধ্যমকর্মী, যারা ফ্যাসিস্টবিরোধী ছিল, তারা হয়রানির শিকার হন। আমাকেও মিডিয়া সেলে কাজ করার অপরাধে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সহকর্মীরাও জানতে পারেননি।”

দৈনিক চাঁদনী বাজারের প্রকাশক সাবু ইসলাম এবং দৈনিক করতোয়ার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রাহাত রিটু বলেন,
“ইন্টারনেট ছাড়া হাতে-কলমে পেস্টিং করে পত্রিকা করতে হয়েছিল। তথ্য না পাওয়ায় পৃষ্ঠা সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়, আর ছাপাতে গিয়ে খরচ হয়েছিল দ্বিগুণ।”

‘সরকার বন্ধ করেনি, বন্ধ হয়ে গেছে’—এক অস্বীকারের ক্ষোভ

তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেনি, এটি বন্ধ হয়ে গেছে’। এ বক্তব্য আজও মানুষের মনে জন্ম দেয় অসন্তোষ ও প্রশ্ন।
একটি ডিজিটাল রাষ্ট্রে ইন্টারনেটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার নজির যেন আর কখনও না হয়—এমন প্রত্যাশা থেকেই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ চান, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের মতো কলঙ্কজনক অধ্যায় ভবিষ্যতে আর না ফিরে আসুক।

উপরে